কোম্পানিটার নাকি জাহাজের ব্যবসা রয়েছে। বিমানও তৈরি করে তারা। সংস্থার ওয়েবসাইট বলছে, সেটির মালিকের মার্সিডিজ বেঞ্জের ডিলারশিপ রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ায়। এ ছাড়া আরও অনেক বিদেশি গাড়ি রয়েছে তার গাড়িশালে। আমেরিকার লাস ভেগাস এবং সান দিয়েগোর দু’টো ঠিকানাও দেওয়া হয়েছে ওই সাইটে।
সান দিয়েগোর অফিসের ঠিকানা ‘ইন্দ্রাণী প্লাজা’। গুগল ম্যাপস-এ ওই নাম দিয়ে খুঁজলে বেরোচ্ছে শুধু একটি পার্কিং লট। ওয়েবসাইট আরও বলছে, লাস ভেগাসের অফিসটা রয়েছে ‘উদয়ন হাইটস’ নামে কোনও এক বাড়িতে। সেই বাড়ির কোনও অস্তিত্ব কিন্তু গুগল ম্যাপস-এ নেই। তা ছাড়া, এই মুহূর্তে গোটা বিশ্বে এমন কোনও তাবড় বড়লোকও নেই, যাঁর একসঙ্গে জাহাজ ও বিমান তৈরির ব্যবসা রয়েছে।
আসলে ‘উদয়ন গ্লোবাল’ নামে ওই কোম্পানিটাই নেই! কোনও দিন ছিল না। স্রেফ একটা ভুয়ো ওয়েবসাইট বানিয়ে রেখেছিল উদয়ন দাস। নিজের বাবা-মা-প্রেমিকাকে নৃশংস ভাবে খুনের দায়ে আপাতত যে পুলিশি হেফাজতে।
প্রশ্ন হল, ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে সাজিয়ে কেন এই ভুয়ো ব্যবসার গল্প ফেঁদে রেখেছিল উদয়ন? গোয়েন্দা ও মনোবিদেরা বলছেন— উদ্দেশ্যটা মূলত আত্মতৃপ্তি। আসলে কল্পজগতেই থাকত উদয়ন। স্বপ্ন দেখত জেগে জেগে। জানত, বাস্তবে সেই সব স্বপ্ন পূরণ হবে না কোনও দিন। তাই নিজের মিথ্যে স্বপ্ন সাজিয়ে রাখত ওয়েবের দুনিয়ায়। উদয়নকে জেরা করে, তার ওয়েবসাইট ও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ঘেঁটে পাওয়া গিয়েছে সেই সব স্বপ্নের ফানুসেরই টুকরো। যেখানে নিজের জগতে সে নিজেই ‘রাজা’।
উদয়নের বাবা বীরেন্দ্র দাসের ফেসবুক প্রোফাইলে লেখা রয়েছে, তিনি ‘মেহরাকর্প’ নামে এক সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। বলা বাহুল্য, এই ফেসবুক প্রোফাইল উদয়নেরই তৈরি। এবং সম্ভবত বাবাকে খুন করার পরে তৈরি। সেই মেহরাকর্পের ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যাচ্ছে, লোহার খনি, তেল উত্তোলন, জাহাজ নির্মাণ, হিরের ব্যবসা, গল্ফ কোর্স— কী ব্যবসা নেই তাদের! সাইটে দাবি করা হচ্ছে, আমেরিকা, চিন, রাশিয়া ছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে রয়েছে সংস্থার কাজ-কারবার। এ-ও বলা হচ্ছে, এই ‘মেহরাকর্প’ থেকে ‘বেরিয়ে এসেই’ ২০১১ সালে তৈরি হয়েছে ‘উদয়ন গ্লোবাল’।
উদয়ন গ্লোবালের মালিক হিসেবে ওয়েবসাইটে রয়েছে ‘উদয়ন ফন রিখটহোফেন মেহরা’-র নাম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জার্মান বৈমানিক ফন রিখটহোফেনের নামের সঙ্গে নিজের নামটা জুড়ে নিয়েছিল উদয়ন। সেই নাম নিজের ফেসবুক প্রোফাইলেও ব্যবহার করত সে। এখনও উদয়ন গ্লোবালের সাইট খুললে ফুটে উঠছে ২০১৪ সালে রাশিয়ার সোচিতে শীতকালীন অলিম্পিক্সের ছবি। কারণ? ওয়েবসাইটের দাবি, ‘উদয়ন গ্লোবাল’ নাকি ছিল ওই গেমসের অন্যতম পার্টনার! এমনকী ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিক্সের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড ইভেন্টের ‘অফিশিয়াল স্পনসর’ও নাকি ছিল তারা।
এ হেন উদয়নকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পরে পুলিশ অফিসারেরাও বেশ অবাক। ভাবলেশহীন সপ্রতিভ এক যুবক। সাধারণ জ্ঞান প্রচুর। কম্পিউটারও গুলে খেয়েছে। আর সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়েছে ওই কল্পজগৎ গড়ে তুলতে।
তবু উদয়নকে মানসিক ভাবে অসুস্থ বলতে চান না মন-চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম। তাঁর মতে, উদয়নের কাজকর্ম দেখলে তাকে ‘কোল্ড ক্যালকুলেটিভ ক্রিমিনাল’ বলেই মনে হয়। তিনি বলেন, ‘‘যা আমরা স্বাভাবিক মনে করি, তার বাইরে কেউ গেলেই তাঁকে মানসিক রোগী বলা ঠিক নয়। উদয়নের মতো মানুষদের মানসিক রোগীর তকমা দিয়ে দিলে, যাঁরা মানসিক রোগী তাঁদের উপরে অন্যায় করা হয়।’’
জয়রঞ্জনবাবু আরও বলেন, ‘‘ছোট থেকেই হয়তো হীনমন্যতায় ভুগতে ভুগতে মনগড়া গল্প তৈরি করেছিল উদয়ন। ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তৈরি সেই কল্পনার জগতে বাবা-মা-প্রেমিকাকেও টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে সে। হতে পারে, এ নিয়ে সংঘাত বাড়তেই তাদের সরিয়ে দিয়েছে উদয়ন।’’ কারণ শুধু তো ধনসম্পদের লোভ নয়, উদয়নের ব্যক্তিগত জীবনটাও ছিল কল্পনা-ভিত্তিক।
উদয়নের মতো আগাগোড়া স্ব-বিরোধিতায় ডুবে থাকা একটি চরিত্রকে কী ভাবে তার নিহত বাবা-মা কিংবা প্রেমিকা আকাঙ্ক্ষা দিনের পর দিন সামলে রাখতেন, সেটাই এখন ভাবাচ্ছে পুলিশ অফিসারদের। তাঁরা বলছেন, এর সব চেয়ে বড় প্রমাণ রয়েছে আকাঙ্ক্ষার ফেসবুক প্রোফাইলেই। গত ডিসেম্বরে ওই প্রোফাইলে প্রেমিকাকে চুম্বনরত অবস্থায় নিজের একটি ছবি পোস্ট
করে উদয়ন লিখেছিল, ‘‘আকাঙ্ক্ষা আমার জীবন। যে ওর গায়ে একটি পিন ফোটানোর চেষ্টা করবে, তার হৃৎপিণ্ডে ছোরা ঢুকিয়ে দেব।’’ পুলিশের ধারণা, ওই পোস্টের অনেক আগেই হয়তো আকাঙ্ক্ষাকে খুন করে ফেলেছিল সে!
গলা টিপে খুন আকাঙ্ক্ষাকে
• গলা টিপে, শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছিল বাঁকুড়ার আকাঙ্ক্ষা শর্মাকে। ময়না-তদন্তের রিপোর্টে মিলেছে এই তথ্য। শনিবার ভোপাল পুলিশের এক কনস্টেবল বাঁকুড়া সদর থানায় ময়না-তদন্তের রিপোর্ট জমা দেন। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার সুখেন্দু হিরা বলেন, ‘‘রিপোর্টে গলা টিপে, শ্বাসরোধ করে খুনের কথা বলা হয়েছে। আকাঙ্ক্ষার গালে কিছু চোটের চিহ্ন মিলেছে। খুনের আগে ধ্বস্তাধস্তির ফলে সেগুলো হয়ে থাকতে পারে।’’ পুলিশ সূত্রের খবর, বাবা বীরেন্দ্র দাস, মা ইন্দ্রাণী দেবী এবং আকাঙ্ক্ষা—তিন জনের ক্ষেত্রেই মৃত্যু নিশ্চিত করতে নিথর হয়ে যাওয়ার পরেও তাঁদের মুখ-মাথা প্লাস্টিক দিয়ে মুড়ে, তা বেঁধে দিয়েছিল উদয়ন। তার দাবি, বিদেশি সিরিয়াল দেখে এই ভাবনা তার মাথায় আসে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy