Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪

ট্রাকে নম্বরপ্লেটের বালাই নেই, দেখেও দেখে না পুলিশ

রবিবার রাত ১টা, হৃদয়পুর মোড়: যশোর রোড দিয়ে ডাকবাংলো মোড়ের দিকে গেল নম্বরপ্লেটবিহীন ট্রাক। কর্তব্যরত দুই পুলিশকর্মী ট্রাকটিকে আটকানোর কোনও চেষ্টাই করলেন না।

রবিবার রাত ১টা, বারাসত ডাকবাংলোর মোেড় নম্বরহীন গািড়। (ডান দিকে) ধুলোয় ঢেকে গিয়েছে নম্বরপ্লেট। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

রবিবার রাত ১টা, বারাসত ডাকবাংলোর মোেড় নম্বরহীন গািড়। (ডান দিকে) ধুলোয় ঢেকে গিয়েছে নম্বরপ্লেট। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

সীমান্ত মৈত্র
শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫ ০১:০২
Share: Save:

রবিবার রাত ১টা, হৃদয়পুর মোড়: যশোর রোড দিয়ে ডাকবাংলো মোড়ের দিকে গেল নম্বরপ্লেটবিহীন ট্রাক। কর্তব্যরত দুই পুলিশকর্মী ট্রাকটিকে আটকানোর কোনও চেষ্টাই করলেন না।

কয়েক মিনিটের ব্যবধান, ডাকবাংলো মোড়: ম্যাটাডরের পিছনে হলুদ রঙের নম্বরপ্লেট, কিন্তু তাতে কোনও নম্বর নেই। অন্তত চোখে কোনও নম্বর দেখা যাচ্ছে না। কখনও কোনও নম্বর ছিল কি না, তা-ও বোঝার কোনও উপায় নেই। সেই ম্যাটা়়ডরে পিছনে আরও একটি মিনি-ট্রাক। তার পিছনে নম্বরপ্লেটই নেই। তবে সেগুলিকেও পুলিশের বাধার মুখে পড়তে হল না। অনায়াসে এগিয়ে গেল। আবার দেখা গেল একটি নম্বরপ্লেটবিহীন ছোট ট্রাক। যশোর রোড ধরে চাঁপাডালির মোড়ের দিকে মুখ তার। পিছু নিয়ে দেখলাম, চাঁপাডালি আইল্যান্ডের কাছে দু’জন পুলিশকর্মী রাস্তায় ‘গার্ড-রেল’ টেনে তল্লাশি করছেন। কিন্তু নম্বরপ্লেটবিহীন ট্রাকটিকে আটকানোর কোনও চেষ্টাই করলেন না তাঁরা।

রাত ১টা ৩০, চাঁপাডালি মোড়: ‘গার্ড-রেল’ রয়েছে। সেখানে ট্রাক দেখলেই আটকানো হচ্ছিল। কিন্তু ঠাহর করা গেল, চালক বা খালাসি পুলিশের হাতে কিছু দিতেই ট্রাক ছেড়ে দেওয়া হচ্ছিল। কয়েকটি ট্রাকের পিছনে নম্বরপ্লেট ছিল না। এরপরই দেখলাম, রাত দেড়টা নাগাদ পর পর তিনটি ট্রাক আসছিল। তাদের পিছনেই ছিল পুলিশের টহলদারি গাড়ি। এ বার পুলিশকর্মীরা বিনা বাধায় ট্রাকগুলিকে ছেড়ে দিলেন। ‘গার্ড-রেল’ পেরনোর সময় এক ট্রাকচালক বলে গেলেন, ‘‘পুলিশের গাড়ি না এলে আমাদেরও টাকা দিতে হতো।’’

পরিবহণ দফতর বলছে

• ট্রাক বা অন্য গাড়িতে পরিবহণ দফতরের দেওয়া নম্বর নম্বরপ্লেট এমন ভাবে লাগাতে হবে, যাতে নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে তা সহজে পড়া যায়। • গাড়ির নির্দিষ্ট জায়গায় সামনে-পিছনে নম্বরপ্লেট থাকতে হবে। • রাতে নম্বরপ্লেট দেখার জন্য গাড়ির সামনে-পিছনে পর্যাপ্ত আলো থাকতে হবে। • নম্বরপ্লেট কোনও ভাবেই ধুলোকাদায় ঢাকা পড়া চলবে না।

রাত ১টা ৪০, বামনগাছি মোড়: আশপাশে কোনও পুলিশ নেই। যে ট্রাকগুলি আসছিল, তার অনেকগুলিতেই নম্বরপ্লেট নেই। কিছু ছোট গাড়িকেও দেখা গেল কোনও নম্বরপ্লেট ছাড়া। কয়েকটি মোটরবাইকেও নম্বর চোখে পড়ল না। অথচ, সেগুলি অনায়াসে যাতায়াত করছে।

রাত ২টো ১০, হাবরা ২ নম্বর রেলগেট: দাঁড়িয়ে রয়েছে পুলিশ-ভ্যান। ভিতরে পুলিশকর্মীরা গল্পে মশগুল। পাশ দিয়েই বেরিয়ে যাচ্ছিল একের পরে এক নম্বরপ্লেটহীন ট্রাক এবং ছোট গাড়ি। গাইঘাটা থানার সামনে পুলিশকর্মীরা আনন্দবাজারের প্রতিনিধিদের গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। তবে ট্রাক বা নম্বরপ্লেটহীন অন্য গাড়ি থামাতে দেখা যায়নি তাঁদের।

রাত সাড়ে ৩টে, বনগাঁ সদর: পুলিশ ছিল। তবে বিনা জিজ্ঞাসাবাদেই ছেড়ে দেওয়া হচ্ছিল ট্রাক এবং লরি।

কী কারণে নম্বরপ্লেটবিহীন গাড়ি বা ট্রাক ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে?

পরিবহণ দফতরের কর্তাদের মতে, একটি নির্দিষ্ট চক্র এই কাজ করছে। প্রথমে গাড়ি চুরি করে গ্যারাজে গিয়ে নম্বর পাল্টে ভুয়ো নম্বরপ্লেট লাগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কোনও কোনও গাড়িতে কোনও নম্বরপ্লেটই লাগানো হচ্ছে না। ফলে, চুরি যাওয়া গাড়ির হদিস পাওয়াই অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে।

রাতের অন্ধকারে পথে নামে পাচারকারীরা। ডাকাতি বা লুঠপাট চালিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে পালানোর প্রবণতাও রয়েছে দুষ্কৃতীদের মধ্যে। এরাই সাধারণত নম্বরপ্লেটবিহীন গাড়ি বা ট্রাক ব্যবহার করে বলে পুলিশ সূত্রের খবর। সূত্রটির দাবি, যে সব ট্রাকে নেশা করার জন্য কাফ সিরাপ বা অন্য বেআইনি পণ্য পাচার করা হয় সেগুলিতেও ‌নম্বরপ্লেট থাকে না। এ ধরনের গাড়িগুলি দুর্ঘটনায় জড়ালে সংশ্লিষ্ট মালিক বা চালকের সন্ধান পেতে কালঘাম ছোটে পুলিশের। ফলে, পিছিয়ে যায় মামলার প্রক্রিয়াও।

উত্তর ২৪ পরগনার জেলা পরিবহণ আধিকারিক সিদ্ধার্থ রায় বলেন, ‘‘বিধি ভেঙে অতিরিক্ত মাল চাপানো ট্রাক ধরে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু নম্বরপ্লেটবিহীন বা ঠিক ভাবে নম্বরপ্লেট না লাগানো গাড়ির উপরে নজরদারি চালানোর মতো কর্মী আমাদের নেই। পুলিশ এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে।’’

পরিবহণ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, নতুন গাড়ি বা ট্রাকের ক্ষেত্রে পরিবহণ দফতরের তরফ থেকেই এখন ‘হাই সিকিওরিটি নম্বরপ্লেট’ লাগিয়ে দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট দিনে আরটিও অফিসে হাজিরা দিলে লাগানো হয় সেই নম্বরপ্লেট। আর পুরনো গাড়ির নথি পরীক্ষা ও নবীকরণ (সিএফ) করানোর সময়ে ট্রাক ও গাড়ি চালকেরা নম্বরপ্লেট ঠিকঠাক লাগিয়ে আনেন। কারণ, তা না হলে নথি নবীকরণ হয় না। সাধারণত ১০ চাকার ট্রাকের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা এবং নবীকরণ করাতে ৫৯০ টাকা দিতে হয়। নিয়ম অনুযায়ী, ট্রাক ও গাড়ির নম্বরপ্লেট এমন ভাবে লাগাতে হবে, যাতে নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে সেটা সহজেই দেখা যায়। পড়া যায়। গাড়ির সামনে-পিছনে দু’দিকেই নম্বরপ্লেট থাকতে হবে। রাতে ওই নম্বরপ্লেট দেখবার জন্য গাড়ির সামনে ও পিছনে পর্যাপ্ত আলো থাকতে হবে। কিন্তু এগুলির কোনটিই মানে না এমন গাড়ি ও ট্রাকের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে জেলা জুড়ে।

প্রশাসন সূত্রের খবর, ওই সব নম্বরহীন বা ঠিক ভাবে নম্বরপ্লেট না লাগানো ট্রাক বা গাড়ির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। ন্যূনতম একশো টাকা জরিমানাও করা যেতে পারে।

পক্ষান্তরে, পুলিশ জানিয়েছে, যদি কোনও ট্রাক বা গাড়িতে আদৌ নম্বরপ্লেট না থাকে বা গা়ড়িতে ঠিকঠাক প্লেটটি লাগানো না থাকে তা হলে অন্য সব নথিপত্র ঠিক থাকলেও ট্রাক বা গাড়ির মালিক এবং চালকের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করা যেতে পারে। তা হলে রবিবার রাতে পুলিশকে তা করতে দেখা গেল না কেন?

উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘নম্বরপ্লেটহীন ট্রাক বা গাড়ি আটকানোর মতো পরিকাঠামো আমাদের জেলা ট্রাফিক পুলিশের নেই।’’ তবে, টাকা নিয়ে পুলিশ চোখ বুজে থাকে, এমন কোনও অভিযোগ মানতে চাননি তন্ময়বাবু। তিনি দাবি করেছেন, ‘‘এ ধরনের অভিযোগ পেলেই আমরা ব্যবস্থা নিই।’’

অন্য বিষয়গুলি:

state news track
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE