Advertisement
৩০ জানুয়ারি ২০২৫
Mamata Banerjee

রাস্তা আর রাস্তা দেখাবে না! সরণির নামে আবর্তিত হবে না তৃণমূলের ধরণী, শীর্ষ নেতৃত্বের স্পষ্ট বার্তা দলকে

গত কয়েক মাসে নানা বিষয়ে তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মধ্যে ‘দূরত্ব’ প্রকাশ্যে এসেছে। নানা ঘটনায় শাসকদলে শিবির বিভাজনে নেতাদের আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যাওয়াও নতুন নয়। কিন্তু ‘রাস্তার নামে লবি’ তাতে নতুন সংযোজন।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ইনলাইন।

শোভন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:২৮
Share: Save:

হ্যারিসন রোড হয়েছে মহাত্মা গান্ধী রোড। থিয়েটার রোড শেক্সপিয়র সরণি। কলকাতায় রাস্তার নাম বদলের ইতিহাস নতুন নয়। তবে সম্প্রতি তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের তরফে একাধিক জেলার নেতৃত্বকে বার্তা দেওয়া হয়েছে, শাসকদল পুরনো রাস্তাতেই চলবে। অর্থাৎ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল ধারা পাল্টাচ্ছে না। আপাতত অন্য কোনও রাস্তা নয়, দল চলবে ৩০বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট (মমতার বাসভবনের ঠিকানা) থেকেই। অন্য কোনও রাস্তা তৃণমূলকে ‘রাস্তা’ দেখাবে না।

সম্প্রতি কাঁথি কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের নির্বাচনের পরে বোর্ড গঠন নিয়ে জেলা তৃণমূলের কোন্দল প্রকাশ্যে এসেছিল, যা মেটাতে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল স্বয়ং মমতাকে। ভবানীপুরের দফতরে পূর্ব মেদিনীপুরের নেতাদের ডেকে বৈঠক করেছিলেন রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী। সেই বৈঠকে মমতা ফোনে বার্তা দিয়েছিলেন জেলার নেতাদের। তার পর মুর্শিদাবাদ সফরে গিয়ে দলীয় নেতাদের বৈঠকে গিয়েও মমতা দলের শৃঙ্খলার বিষয়ে কড়া বার্তা দিয়েছেন জেলার নেতাদের। তৃণমূল সূত্রের খবর, দু’টি বৈঠকেই নেত্রী মমতা বলেছেন, কোনও ‘রাস্তার নামে লবিবাজি’ (গোষ্ঠী রাজনীতি) করা চলবে না! মালদহের নেতৃত্বকেও একই ভাবে শীর্ষনেত্রী মমতা বুঝিয়ে দিয়েছেন, দলে যিনিই লবি করুন, তাঁকে রেয়াত করা হবে না।

মমতার সেই বাক্যবন্ধ গোড়ায় অনেক জেলার নেতারই বোধগম্য হয়নি। কিন্তু ‘রাস্তার নামে লবিবাজি’ নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। জেলার নেতাদের কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে কলকাতার নেতাদের কাছেও জানতে চেয়েছেন, ‘রাস্তার নামে লবিবাজি’ বিষয়টি কী? এ কোন রাস্তা? এ ব্যাপারে স্পষ্ট বা আনুষ্ঠানিক কোনও ব্যাখ্যা প্রত্যাশিত ভাবেই মেলেনি। তবে তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাদের অনেকেই দলীয় সমীকরণের সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে বিষয়টি দেখে ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করছেন। তাঁদের মতে, রাস্তাটি হল ক্যামাক স্ট্রিট। যেখানে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দফতর।

তৃণমূলের অন্দরে দু’টি ঠিকানার গুরুত্ব অপরিসীম। এক, কালীঘাট। দুই, ক্যামাক স্ট্রিট। বস্তুত, অভিষেক সম্পর্কে কিছু বলার সময়ে দলের নেতারা সম্ভ্রম ভরে ‘ক্যামাক স্ট্রিট বলেছে’ বা ‘ক্যামাক স্ট্রিট চাইছে’ ইত্যাদি বাক্যবন্ধ ব্যবহার করেন। দলের অন্দরে যাঁরা অভিষেক-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত, তাঁদেরও অভিহিত করা হয় ‘ক্যামাক স্ট্রিটের’ লোক বলে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরে পেশাদার পরামর্শদাতা সংস্থাকে দলের সঙ্গে যুক্ত করা, তার পরবর্তী সময়ে দলীয় কাজকর্মে যে ‘কর্পোরেট’ মোড়ক পড়েছে, তাকেও ‘ক্যামাক স্ট্রিট ঘরানা’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই সমস্ত ‘সূচক’ ধরেই নেতাদের উপসংহার— যে ‘রাস্তার নামে লবি’, সে রাস্তা হল ক্যামাক স্ট্রিট।

সম্প্রতি ক্যামাক স্ট্রিটের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত একাধিক নেতাকে দলের মুখপাত্রের পদ থেকে সরানো হয়েছে। প্রশাসনিক স্তরেও যাঁরা ‘ক্যামাক স্ট্রিট-ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত, তাঁদেরও কাউকে কাউকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে সরানো হয়েছে। প্রশাসনিক স্তরে সেই রদবদলও আসলে ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’। গত কয়েক মাসে নানা বিষয়ে তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মধ্যে ‘দূরত্ব’ প্রকাশ্যে এসেছে। নানা ঘটনায় শাসকদলে শিবির বিভাজনে নেতাদের আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যাওয়াও নতুন নয়। সম্প্রতি তাতে যোগ হয়েছে ‘ক্যালেন্ডার-কাণ্ড’। অভিষেকের দফতর থেকে ২০২৫ সালের ক্যালেন্ডার পাঠানো হয়েছিল দলের জেলা সভাপতিদের। সেই ক্যালেন্ডারে মমতা এবং অভিষেক দু’জনেরই ছবি থাকলেও অভিষেকের ছবিটি তুলনায় মমতার থেকে মাপে বড় ছিল। জেলায় জেলায় ক্যালেন্ডার পৌঁছনোর পর রাজ্য নেতৃত্বের কাছে বড়-ছোট ছবির খবর যায়। পত্রপাঠ পদক্ষেপ করা হয়। রাজ্য নেতৃত্বের তরফে জেলা সভাপতিদের কাছে বার্তা যায়, ওই ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা যাবে না। তৃণমূলের একাধিক জেলা সভাপতি জানান, তাঁদের কাছে অভিন্ন বার্তা এসেছিল রাজ্য নেতৃত্বের তরফে। বলা হয়েছিল, ‘দিদি’ এই ছবি ব্যবহার করেন না। তাই এই ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা যাবে না। তার পরে আবার একটি নকশা তৈরি করে ক্যালেন্ডার পাঠানো হয় জেলায় জেলায়। পরিবর্তিত নকশায় অভিষেকের তুলনায় মমতার ছবি বড় থাকলেও তাতে রাজ্য নেতৃত্বের সিলমোহর রয়েছে কি না, তা স্পষ্ট হয়নি।

ইতিমধ্যেই ‘রাস্তার নামে লবি’তে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। আলোচনার মূল বিষয় সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ‘সমীকরণ’। উল্লেখ্য, গত ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে অভিষেক ঘোষণা করেছিলেন, লোকসভা ভোটে ফলাফলের নিরিখে তিন মাসের মধ্যে পুরসভা স্তরে প্রশাসন ও সংগঠনে রদবদল হবে। গত সেপ্টেম্বরে মমতাকে সেই সংক্রান্ত প্রস্তাব অভিষেক জমাও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই রদবদল এখনও হয়নি। যদিও তৃণমূলের অনেকেই একান্ত আলোচনায় বলছেন, কিছু কিছু রদবদল হবে। সে ব্যাপারে নেত্রী মমতাই যা করার করছেন।

সেই রদবদলেও ক্যামাক স্ট্রিট এবং কালীঘাটের ‘দূরত্ব’ প্রতিফলিত হবে কি না, তা নিয়ে জল্পনা চলছিলই। ‘রাস্তা’ সেই জল্পনায় বাড়তি ইন্ধন জুগিয়েছে। কারণ, দলের সর্বময় নেত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন রাস্তা (ক্যামাক স্ট্রিট) আপাতত আর রাস্তা দেখাবে না। সরণির নামে আবর্তিত হবে না তৃণমূলের ধরণী!

অন্য বিষয়গুলি:

Mamata Banerjee TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy