—ফাইল চিত্র।
শুক্রবারের সন্ধে।
তারায় তারায় ঝলমল করছে বালিগঞ্জের ‘উৎসব’ বাড়িটার একতলা।
ওঁরা সবাই একটা ঘরে।
দেব, জিৎ, যিশু, আবির, ঋত্বিক, সোহম, হিরণ, শ্রাবন্তী, তনুশ্রী, মিমি, নুসরত। এবং অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়।
এবং প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়— ‘উৎসব’-এর গৃহকর্তা।
নির্ভেজাল আড্ডা আর ভূরিভোজ, এই ছিল জমায়েতের লক্ষ্য। কিন্তু আড্ডা শুরু হতেই তার মোড় গেল ঘুরে। বিষয় গুরুতর। টালিগঞ্জের অঘোষিত ‘অভিভাবক’ প্রসেনজিতের সামনে মোটামুটি একটা মিটিং বসে গেল অভিনেতা-অভিনেত্রীদের।
উপলক্ষ একটা চিঠি। যার ভাষা এবং বয়ান নিয়েই তারকারা ক্ষুব্ধ, অপমানিত। প্রযোজকদের বিভাজন নিয়ে ইতিমধ্যেই জলঘোলা চলছে টালিগঞ্জে। চিঠির ব্যাপারটা কী?
এই চিঠির প্রেরক ‘ফেডারেশন অব সিনে টেকনিশিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’। যার শীর্ষ পদে আছেন রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ভাই তথা তৃণমূল নেতা স্বরূপ বিশ্বাস। টালিগঞ্জের অভিনেতা-লেখক থেকে শুরু করে ফাইট মাস্টারদের গিল্ডের মতো ২৬টি সংগঠন রয়েছে এই ফেডারেশনের অধীনে। যার একটি, অভিনেতাদের সংগঠন ‘আর্টিস্ট ফোরাম’।
সম্প্রতি আর্টিস্ট ফোরাম-সহ প্রত্যেকটি সংগঠনের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছে ফেডারেশন। তাতে বলা হয়েছে, সব সংগঠনের সমস্ত সদস্যকে তাঁদের পাসপোর্টের আগাগোড়া ফোটোকপি করে ফেডারেশনের অফিসে জমা দিতে হবে। না হলে তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে! এই ফতোয়াতেই ক্ষুব্ধ অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। আর্টিস্ট ফোরাম-এর সভাপতি অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় তো ওই সন্ধেয় প্রসেনজিতের বাড়িতেই ছিলেন। সেখানেই উপস্থিত অন্য সব তারকারা একযোগে একটি চিঠিতে সই করে জানিয়ে দিয়েছেন, ফেডারেশনের এই নির্দেশ তাঁরা মানেন না।
কেন এই ফতোয়া?
ফেডারেশন এখন নিয়ম করেছে, বিদেশে শ্যুটিং করতে গেলে অন্তত ১৯ জন টেকনিশিয়ানকে নিয়ে যেতেই হবে। কিন্তু এ মাসের শুরুতে লন্ডনে প্রযোজক অশোক ধানুকার ছবির শ্যুটিংয়ে ১৯ জনের বদলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ১৬ জনকে। তাতে বিস্তর জলঘোলা হয়। এমনকী কলকাতায় বসেই শ্যুটিং বন্ধ করে দেয় ফেডারেশন। তার পর মোটামুটি একটা মিটমাট গোছের হয়েছিল। কিন্তু এ বার তাদের সুর আরও চড়া।
কিন্তু অভিনেতারা পাসপোর্টের কপি জমা দেওয়া নিয়ে এই চরমপত্র মানতে নারাজ। দেব বলছিলেন, ‘‘পাসপোর্টের জেরক্স ফেডারেশনকে দিতে হবে— এই ব্যাপারটা আমি সমর্থন করি না। এটা কেন করতে যাব? আমাদের ধারণা, একসঙ্গে বসে কথা বললেই ব্যাপারটা মিটে যাবে। তবে এ রকম চিঠি লেখাটা একেবারেই রাইট অ্যাপ্রোচ নয়।’’
দেবের সঙ্গে একমত সোহমও। বরং তাঁর সুর আরও চড়া। বলছেন, ‘‘ফেডারেশন আমাদের শাস্তি দেওয়ার কে? এই নিয়েই আমরা বুম্বামামার বাড়িতে একটা মিটিং করেছি গত শুক্রবার। ফেডারেশন যে চিঠিটা লিখেছে, সেটা পেয়ে সত্যি বলতে আমরা দুঃখই পেয়েছি। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে— এগুলো খুব অপমানজনক কথা। আমরা কি স্কুলের ছেলে-মেয়ে?’’ চিঠি নিয়ে আপত্তি রয়েছে হিরণেরও। তিনিও বলছেন, “এ রকম চিঠি সমর্থনযোগ্য নয়।’’
মনে রাখতে হবে, যে তিন জনের কথা উপরে বলা হল, তাঁদের মধ্যে প্রথম জন তৃণমূল সাংসদ। পরের দু’জন রাজ্য তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সহ-সভাপতি। ফেডারেশনের প্রধান স্বরূপ তো তাঁদের দলেরই লোক। এটা তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর ঝামেলা নয় তো?
সোহম বলছেন, ‘‘দেখুন, এটায় কোনও রাজনৈতিক রং লাগাবেন না। আমি পদের দিক থেকে হয়তো উপরে আছি। কিন্তু সেটাকে বাইরে রেখেই বলছি, এখানে রাজনীতি দেখাটা অবান্তর। তবে স্বরূপদার সঙ্গে দেখা হলে আমি ব্যক্তিগত ভাবে বলব, এ রকম চিঠি লেখা উচিত হয়নি।’’
স্বরূপ কী বলছেন? আনন্দবাজারের প্রতিবেদককে তিনি বললেন, ‘‘আপনার কাছেই প্রথম শুনলাম যে, আর্টিস্টরা এই রকম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। নিশ্চয়ই একটা কোনও ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। আমি সোমবারই সবার সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিতে চাইব।’’
ফেডারেশনের তরফ থেকে অপর্ণা ঘটক অবশ্য বলছিলেন, তাঁদের হাত-পা বাঁধা। তাঁর কথায়, ‘‘লন্ডনে শ্যুটিংয়ের সময় যে অসুবিধে হয়েছে, তার পরেই আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের কাছে পাসপোর্টের কপি থাকলে আমরা ঠিক বুঝতে পারব কার পাসপোর্ট বৈধ, কার কোন দেশের ভিসা রয়েছে। আমরা মানছি সমস্যাটা শিল্পীদের নিয়ে হয় না। হয় কলাকুশলীদের নিয়ে। কিন্তু আমাদের অধীনে থাকা ২৬টা গিল্ডের মধ্যে আমরা ভেদাভেদ কী করে করব বলুন? তাই আর্টিস্ট ফোরামকেও চিঠি পাঠানো হয়েছে।’’ তবে অপর্ণাও মনে করছেন, শিল্পীরা তাঁদের ভুল বুঝেছেন। কথা বললেই ব্যাপারটা মিটে যাবে।
আর্টিস্ট ফোরামের সচিব অরিন্দম বলছিলেন, ‘‘চিঠিটা অফিসে আমার হাতে আসা মাত্রই বুঝেছিলাম এটা নিয়ে চূড়ান্ত অসন্তোষ হবে। আর্টিস্টরা যদি রেগে যান, তা হলে সেই রাগটা যথেষ্ট ন্যায্য।’’ বাংলা ছবির প্রথম সারির এক ডজন মুখ মহাজোট গড়ে ফেডারেশনের নির্দেশ অমান্য করছেন, সেটা টালিগঞ্জে একটা ছোটখাটো ঝড় তো বটেই। এই প্রশ্নটাও উঠছে, ইন্ডাস্ট্রির সব ব্যাপারে কি তা হলে আর ফেডারেশন এবং স্বরূপ বিশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ নেই?
এর উত্তর হয়তো সময়ই দেবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy