পরিযায়ী শ্রমিককে হাসপাতাল নিয়ে যাচ্ছেন সত্যকাম। নিজস্ব চিত্র।
শাসক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ার খবর যখন রাজ্যের নানা প্রান্তে, তখন ঠিক উল্টো ছবি জঙ্গলমহলের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। পরিযায়ী শ্রমিক গ্রামে ফিরেছেন, জ্বরও রয়েছে বলে খবর। কিন্তু পরীক্ষা করানোর কোনও উদ্যোগ নেই। না পরিবারের তরফে, না প্রশাসনের তরফে। এই পরিস্থিতিতে একা এগিয়ে গেলেন স্থানীয় তৃণমূল যুবনেতা। পিপিই কিট পরে বাইক নিয়ে হাজির হলেন পরিযায়ী শ্রমিকের বাড়ি। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করিয়ে ফের পৌঁছে দিয়ে গেলেন বাড়ির উঠোনে। গোটা গোপীবল্লভপুরে এখন চর্চা যুবনেতা সত্যকাম পট্টনায়েককে নিয়ে।
ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপুরে সত্যকাম এমনিতে বেশ পরিচিত নেতা। কারণ তিনি গোপীবল্লভপুর-১ ব্লক যুব তৃণমূলের সভাপতি তিনি। সাংগঠনিক এবং সামাজিক কাজে করিৎকর্মা হিসেবে খ্যাতি রয়েছে। কিন্তু জ্বরে ভুগতে থাকা রোগীকে কোভিড পরীক্ষার জন্য বাইকে চাপিয়ে নিজে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে যে নজির সত্যকাম পট্টনায়ক ১০ অগস্ট তৈরি করেছেন, তা অনেককেই চমকে দিয়েছে। সত্যকামের পরিচয়টাই যেন রাতারাতি বদলে গিয়েছে এলাকায়।
গোপীবল্লভপুরের সিজুয়া গ্রামে সম্প্রতি ফিরেছেন পরিযায়ী শ্রমিক অমল বারিক। কয়েক দিন আগে জানা যায়, তাঁর জ্বর এসেছে। অমলের পরিবারের লোকজন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করতে পারেননি। স্থানীয় প্রশাসনকে সে বিষয়ে খবর দেওয়া হয়েছিল। তবে অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা হয়নি। ফল জ্বরে ভুগতে থাকা অমল বারিককে নিয়ে তাঁর গ্রাম সিজুয়ায় কিছুটা আতঙ্কই তৈরি হচ্ছিল। সেই আতঙ্কই কাটিয়ে দিলেন যুব তৃণমূলের সত্যকাম।
গোপীবল্লভপুরের তৃণমূল যুবনেতা সত্যকাম পট্টনায়েক। নিজস্ব চিত্র।
যেখানে সত্যকাম থাকেন, সেখান থেকে এই সিজুয়ার দূরত্ব ৩ কিলোমিটার। ১০ অগস্ট অর্থাৎ সোমবার সকাল থেকে তিনি আটঘাট বেঁধেই সিজুয়ায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। স্থানীয় ওষুধের দোকান থেকে প্রথমে পিপিই কিট কেনেন সত্যকাম। তাতে সর্বাঙ্গ মুড়ে বাইক নিয়ে হাজির হন অমল বারিকের বাড়ি। জ্বরে ভুগতে থাকা অমলকে বাইকের পিছনের সিটে বসিয়ে তিনি সোজা পৌঁছন সরকারি হাসপাতালে। চিকিৎসক অমলকে পরীক্ষা করে তাঁর লালারসের নমুনা সংগ্রহ করেন। তার পরে সত্যকাম ফের অমলকে বাইকে চাপিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেন।
আরও পড়ুন: অনাস্থা প্রস্তাব আনছে বিজেপি, গহলৌতের সঙ্গে বৈঠক সচিনের
তৃণমূল যুব কংগ্রেসের ব্লক সভাপতির এই তৎপরতার কথা সামনে আসতেই প্রশংসা শুরু হয়েছে নানা মহলে। রাজ্য জুড়ে নানা ক্ষেত্রে এর ঠিক বিপরীত ছবিই দেখা যাচ্ছে। কোথাও করোনা আক্রান্তকে একঘরে করার চেষ্টা, কোথাও হাসপাতাল চত্বরে রোগীকে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে দেওয়ার লোক না মেলার ছবি, কোথাও কোভিডে মৃতের দেহ সৎকারে বাধা। আতঙ্কে যখন এমন দিশাহারা আচরণের খবর আসছে নানা প্রান্ত থেকে, তখন সত্যকাম পট্টনায়ক যে নজির তৈরি করেছেন, তা গোটা রাজ্যের জন্য শিক্ষনীয় বলে মনে করছেন স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্তারা।
লকডাউনে যাঁদের কাজ বন্ধ, তাঁদের সহায়তা করার সরকার নানা রকম সহায়তা প্রকল্প এবং ত্রাণ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। সে সবের সুবিধা ঠিক মতো মিলছে না বা ত্রাণ বণ্টনে দুর্নীতি হচ্ছে— এমন নানা অভিযোগে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ হয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই অভিযোগের তির নানা স্তরের তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে। এমন এক পরিস্থিতিতে গোপীবল্লভপুরের যুব তৃণমূল নেতা যে নজির তৈরি করেছেন, তা কিন্তু ক্ষোভ-বিক্ষোভের আখ্যানে একেবারে উলটপূরাণ। সরকারি ত্রাণ বা সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের সুবিধা নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে যাঁরা স্বচ্ছ ভাবে কাজ করছেন, তাঁরা প্রশংসা তো পাচ্ছেনই। কিন্তু সত্যকাম পট্টনায়ক যা করেছেন, তা সে সবের চেয়েও অনেক বেশি বলে মনে করছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতারাই।
আরও পড়ুন: কলকাতায় চিকিৎসার অধিকারে বঞ্চিত হয়েই বহু মৃত্যু, কারণ কিন্তু একচেটিয়া ব্যবসা
সত্যকামের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ঝাড়গ্রাম জেলা তৃণমূলের কো-অর্ডিটেনর উজ্জ্বল দত্ত। তাঁর কথায়, ‘‘সত্যকাম খুব কাজের ছেলে। পিপিই পরে একজনকে বাইকে চাপিয়ে হাসপাতালে পরীক্ষা করাতে নিয়ে গেল বলে আজ হয়তো সবার নজরে পড়েছে। কিন্তু ও অনেক দিন ধরেই কাজ করছে।’’ গোপীবল্লভপুর-১ ব্লকে যে সব পরিযায়ী শ্রমিকরা ফিরেছেন বা কর্মহীন হয়ে যাঁরা ঘরে বসে রয়েছে লকডাউনের জেরে, গত কয়েক মাস ধরে একটানা তাঁদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা সত্যকাম করছিলেন বলে উজ্জ্বলের দাবি। তিনি আরও বলেন, ‘‘গোপীবল্লভপুর তো বাংলা আর ওড়িশার সীমানা। লকডাউন শুরু হওয়ার পর অনেক পরিযায়ী শ্রমিক এখানে এসে দিনের পর দিন আটকে ছিলেন। বিধিনিষেধের কারণে এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে ঢুকতে পারছিলেন না। সত্যকাম তাঁদের জন্যও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।’’
যাঁকে নিয়ে এত হইচই, সেই সত্যকাম নিজে কী বলছেন? তাঁর কথায়, ‘‘প্রশংসা পাব ভেবে তো কিছু করিনি। আমি খবর পেয়েছিলাম যে, এক জন জ্বরে ভুগছেন কিন্তু কিছুতেই পরীক্ষা করানো হচ্ছে না। তাই আমি নিজেই ব্যবস্থা করেছি। এখন জেলা নেতৃত্ব থেকে রাজ্য নেতৃত্ব, সবাই প্রশংসা করছেন। ভাল লাগছে।’’ তবে সত্যকামের আরও ভাল লাগছে অন্য একটা সুসংবাদে। জ্বরে ভুগতে থাকা যে অমল বারিককে তিনি বাইকে চাপিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন হাসপাতালে, তাঁর কোভিড পরীক্ষার রিপোর্ট এসে গিয়েছে। সত্যকামের কথায়, ‘‘ওঁর রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। এটাই সবচেয়ে স্বস্তির খবর।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy