(বাঁ দিকে) ভরতপুরের হুমায়ুন কবীর। ডেবরার হুমায়ুন কবীর (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
এক জনকে শো-কজ়ের চিঠি পাঠানো হয়েছে। আর এক জনকে সতর্ক করা হয়েছে মৌখিক ভাবে। প্রথম জন মুর্শিদাবাদের ভরতপুরের বিধায়ক। দ্বিতীয় জন পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরার। দু’জনেই রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী। দু’জনেই হুমায়ুন কবীর। এবং দু’জনেই আপাতত নিজেদের দলের আতশকাচের নীচে। দলের অন্দরে দু’জনেই খানিক কোণঠাসা। বস্তুত, ভরতপুরের হুমায়ুনকে শো-কজ় করেছে তৃণমূল। ওই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ডেবরার হুমায়ুনকেও ‘বার্তা’ দিতে চেয়েছেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। যে বার্তার নির্যাস স্পষ্ট— দলের অন্দরে থেকে দলের বা সরকারের নীতি নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তোলা দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের সামিল। ভরতপুরের তৃণমূল বিধায়ক ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন, দল তাঁকে বহিষ্কার করলে তিনি নতুন দল গড়বেন। তবে ডেবরার হুমায়ুন সুর বদল করেছেন। পঞ্চায়েত ভোটের আগে থেকেই নিজের অনুগামীদের প্রার্থী করার ব্যাপারে দৌত্য চালাচ্ছিলেন ভরতপুরের হুমায়ুন। কিন্তু যখনই বুঝতে পারেন, তা হচ্ছে না, তখনই দলের বিরুদ্ধে, এমনকি, নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেও মুখ খুলেছিলেন। মুর্শিদাবাদ জেলা তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেত্রীর কথায়, ‘‘হুমায়ুন চেয়েছিলেন তাঁর এক অনুগামীকে জেলা পরিষদে পাঠাতে। তাঁর পাখির চোখ ছিল পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ পদ। সেটা না হওয়াতেই তিনি দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করছেন।’’ ওই নেত্রী এ-ও বলেন, ‘‘আসলে পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ পদে নিজের লোককে বসিয়ে হুমায়ুন তাঁকে ঘিরে থাকা ঠিকাদারদের তুষ্ট করতে চেয়েছিলেন। সেটা না হওয়াতেই যত গন্ডগোল।’’
ভরতপুরের হুমায়ুন যে ভাবে দলে থেকেও দলের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন, তৃণমূল সেটা বরদাস্ত করতে রাজি নয়। তাই তাঁকে শো-কজ় করা হয়েছে। চিঠি পেয়ে হুমায়ুন বলেছেন, তিনি সোমবার দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর সঙ্গে দেখা করে শো-কজ়ের জবাব দেবেন। সেই জবাবে তৃণমূলের ‘সন্তুষ্ট’ হওয়ার সম্ভাবনা কতটা, তা নিয়ে জল্পনা রয়েছে। সম্ভবত হুমায়ুন নিজেও তা জানেন। তাই তিনি আগেই নতুন দল গঠনের হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন। তবে তৃণমূল তাঁকে বহিষ্কার না-ও করতে পারে। কারণ, বহিষ্কার করলে হুমায়ুন বিনা বাধায় অন্য দলে যোগ দিতে পারবেন। সে কারণেই শো-কজ়ের জবাবে সন্তুষ্ট না হলে হুমায়ুনকে সাসপেন্ড করতে পারে দল। হুমায়ুন এক সময় ছিলেন কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর লোক। পরে তিনি অধীর-শিবির থেকে সরে তৃণমূলে যান। ভোটে হেরেও প্রথম মমতা সরকারে মন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। ছ’মাসের মধ্যে উপনির্বাচনে ফের হেরে যান। সে কারণে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয় তাঁকে। তার পর বিজেপি ঘুরে ফের তৃণমূলে ফেরেন। জেলা ও রাজ্য তৃণমূলের একাধিক নেতার বক্তব্য, লোকসভার আগে ভরতপুরের হুমায়ুন আবার কংগ্রেস তথা অধীর-শিবিরের সঙ্গে সেতুবন্ধন করতে চাইছেন। অন্য দিকে, ডেবরার বিধায়ক তথা প্রাক্তন আইপিএস হুমায়ুন শুক্রবার বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতার ‘স্বপ্নের প্রকল্প’ লক্ষ্মীর ভান্ডার নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলেন। যে প্রশ্নের মধ্যে অনেকে ‘উস্কানি’ দেখতে পাচ্ছিলেন। ডেবরার হুমায়ুন ‘প্রতীচী’ ট্রাস্টের রিপোর্টের উল্লেখ করে বিধানসভায় প্রশ্ন তোলেন, ‘‘তফসিলি জাতি এবং উপজাতি মহিলাদের মতো মুসলমান মহিলাদের লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পে ১০০০ টাকা দেওয়া হবে কি?’’ সেই সঙ্গে এ-ও বলেন, ‘‘মুসলমান মহিলাদের অবস্থা আর্থিক ভাবে ভাল নয়। আমরা যখন পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে গিয়েছিলাম, তখন ওই ধরনের (মুসলমান) মহিলারা বলছিলেন, আমরা তো ভোট দিই। আমরা ৫০০ টাকা পাচ্ছি, ওরা (তফসিলি জাতি ও তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ের মহিলারা) ১০০০ টাকা পাচ্ছে।’’
অধিবেশন কক্ষ থেকে বার হওয়ার পরেই হুমায়ুনকে কার্যত ঘিরে ধরেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, মুখ্য সচেতক নির্মল ঘোষ এবং উপ মুখ্যসচেতক তাপস রায়। সূত্রের খবর, হুমায়ুনকে অরূপ বলেন, তিনি এক জন শিক্ষিত মানুষ। তৃণমূলের বিধায়ক হয়ে তিনি কী ভাবে ওই রকম একটা আলটপকা প্রশ্ন তুলে দিলেন! অরূপ-তাপসদের অভিব্যক্তি দেখে হুমায়ুন সম্ভবত বুঝতে পারেন, গোলমাল হয়ে গিয়েছে। কিছুটা প্রলেপ দেওয়ার জন্যই বিধানসভার বাইরে বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই মা লক্ষ্মী রূপে লক্ষ্মীর ভান্ডার দিচ্ছেন। এটি একটি মাইলফলক প্রকল্প। আমি এটাই বলতে চেয়েছি।’’ তবে স্পষ্টতই সভার ভিতরে এবং বাইরে হুমায়ুনের বক্তব্যে বিস্তর ফাঁক রয়ে গিয়েছে। তৃণমূল সূত্রে খবর, পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা নেতৃত্ব ডেবরার হুমায়ুনের উপর ক্ষুব্ধ। নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রে তিনি নিয়মিত যান না বলেও অভিযোগ। জেলা স্তরের এক প্রথম সারির নেত্রী মুখ্যমন্ত্রী মমতার কাছে একাধিক বার হুমায়ুনকে নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন। শাসকদল ইতিমধ্যেই ডেবরার হুমায়ুনকে জানিয়ে দিয়েছে, বিধানসভায় প্রশ্ন করার আগে তা মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে দেখিয়ে নিতে হবে। তৃণমূলের শীর্ষ সারির একাধিক নেতার বক্তব্য, মন্ত্রিত্ব খোয়ানোর ‘হতাশা’ থেকেই দলকে বিড়ম্বনায় ফেলার কৌশল নিয়ে থাকতে পারেন হুমায়ুন। তাঁদের এ-ও বক্তব্য, কিন্তু এ সব করে ‘চাপ’ তৈরি করা যাবে না। নেতাদের ব্যাখ্যা, ‘‘হুমায়ুন প্রশাসন থেকে রাজনীতিতে এসেছেন। তিনি মাঠে-ময়দানের রাজনীতি বোঝেন না। সংগঠন বা বিভিন্ন বাস্তবতা সম্পর্কে তাঁর সম্যক ধারণা নেই। তাই তিনি যা ভাবছেন তা হবে না।’’ তবে এই নেতাদের আশা, ডেবরার হুমায়ুন ‘বার্তা’ পেয়ে গিয়েছেন। এর পর থেকে তিনি ‘ভেবেচিন্তেই’ মুখ খুলবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy