Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Thread Ceremony

মেয়েদের আবার পৈতে হয় নাকি? প্রশ্নের জবাব দিয়ে বৈদিক যুগের শরণে খড়দহের শরণ্যা

রবিবার দুপুরে হলুদ শাড়ি, রংবেরঙের গয়না পরে চারিদিকের সাজসাজ উৎসবের মানে বোঝার চেষ্টা করছিল দশ বছরের মেয়েটি। তাকে ঘিরেই সব আয়োজন।

শারণ্যার পৈতে

শারণ্যার পৈতে নিজস্ব চিত্র।

সারমিন বেগম
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৯:৩৯
Share: Save:

'বামুন চিনি পৈতে প্রমাণ, বামনি চিনি কী প্রকারে...'। ফকির লালনের এই প্রশ্নের মধ্যেই রয়ে গিয়েছে সেই চিরন্তন কথা, পৈতে তো হয় বামুনের। মানে ছেলেদের। মেয়েদের আবার উপবীত ধারণের রেওয়াজ আছে নাকি! কিন্তু ছিল। বৈদিক যুগে মেয়েরাও 'দ্বিজা' হতেন। সেই হারিয়ে যাওয়া দিনের কথা ২০২২ সালে মনে করাল পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী শরণ্যা। উত্তর ২৪ পরগনার খড়দহের বাসিন্দা শরণ্যা ভট্টাচার্য। না, সে এখনও ধর্ম, নিয়ম, রীতি, বৈদিক যুগ- এ সব কিছুই বোঝে না। তবে শরণ্যার স্কুল শিক্ষিকা মা প্রচলিত রীতির পরিপন্থী হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আর তার জেরেই রবিবার বৈদিক মতে দ্বিতীয় জন্ম শুরু করল শারণ্যা।

রবিবার দুপুরে হলুদ শাড়ি, রংবেরঙের গয়না পরে চারিদিকের সাজসাজ উৎসবের মানে বোঝার চেষ্টা করছিল দশ বছরের মেয়েটি। তাকে ঘিরেই সব আয়োজন। নিজে আগে পৈতে বা উপনয়ন দেখেছে। সে সব দাদাদের। কিন্তু এ বার তারই পৈতে। ছোট্ট মেয়েটি বলল, ‘‘মা বলেছে, আজ আমার দ্বিতীয় জন্ম হবে।’’ মেয়ের পৈতে দিতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি মা সুতপা দেবরায়কে। ব্রাহ্মণ পরিবারে ছেলেদের পৈতে তো হয়ই। কিন্তু মেয়ের পৈতে! অনেক বিস্ময়ের জবাব দিতে, মেয়ের অধিকার বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মা সুতপা। পারলেনও। দু’বছর ধরে কোথায় পালিত হবে এই অনুষ্ঠান তা খোঁজ করার পরে রবিবার পূরণ হল স্বপ্ন। উত্তর কলকাতার আর্য সমাজ মন্দিরে উপনয়ন হল সুতপার বালিকা কন্যা শরণ্যার।

সুতপা বলেন, "বৈদিক যুগ থেকেই মেয়েদের পৈতে দেওয়ার প্রথা চলে আসছে। এখন পৈতে শুনলেই ছেলেদের কথা মনে এলেও আদি বৈদিক যুগে এ ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ে বিভাজন ছিল না।'' মেয়ের পৈতে দেবেন বলে তিনি যে শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন, তা বুঝিয়ে রানাঘাটের নপাড়া হাইস্কুলের শিক্ষাবিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষিকা সুতপার প্রশ্ন, ‘‘বেদ বা প্রাচীন কাব্য থেকেই জানা যায়, বৈদিকযুগে মেয়েদেরও পৈতে হত‌। সময়ের সঙ্গে উপনয়ন শুধু ছেলেদের হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সেটা হবে কেন?’’

উত্তর কলকাতার আর্য সমাজ মন্দিরে উপনয়ন হল সুতপার বালিকা কন্যা শরণ্যার।

উত্তর কলকাতার আর্য সমাজ মন্দিরে উপনয়ন হল সুতপার বালিকা কন্যা শরণ্যার। নিজস্ব চিত্র।

পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির কথাতেও সুতপার বক্তব্যের সমর্থন মেলে। তিনি জানান, বৈদিক যুগে গার্গী, লোপামুদ্রার মতো মহিলা ঋষিরাও ছিলেন। তাঁরা তো শুধু মন্ত্রোচ্চারণ করতেন না, `মন্ত্রদর্শনও’ করেছেন। সেখানে ছেলে-মেয়ে কোনও বাধা হয়নি। তিনি বলেন, ‘‘উপ অর্থাৎ কাছে, নয়ন মানে যাওয়া। এখানে হচ্ছে লেখাপড়ার জন্য গুরুর কাছে যাওয়া। বর্তমানে তো মেয়েরা স্কুলে যায়। সেদিক থেকে দেখলে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সব মেয়ের উপনয়ন করিয়েয়েছেন।’’

পলতা এয়ারফোর্স স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে শরণ্যা। তাঁর পৈতে হওয়া কি ওইটুকু মেয়ের মনে গর্ববোধের জন্ম দিতে পারে? সুতপা সে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে বলেন, ‘‘ব্রাহ্মণ হোক বা শূদ্র, বিভিন্ন বয়সে তাদের পৈতে হতে পারে। সমাজে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ ভেদে সকলের সমান অধিকার রয়েছে, উদারতার শিক্ষা দিয়েছি মেয়েকে।’’

আর্য সমাজ মন্দিরে মাসি, মেসো, কাকা, দিদিমার উপস্থিতিতে হয় অনুষ্ঠান।

আর্য সমাজ মন্দিরে মাসি, মেসো, কাকা, দিদিমার উপস্থিতিতে হয় অনুষ্ঠান।

হঠাৎ মেয়ের পৈতে দেওয়ার কথা ভাবলেন কেন? সুতপা জানান, স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের বৈদিক যুগের কথা বলতে গিয়েই মেয়ের পৈতে দেওয়ার ভাবনাটা মাথায় আসে প্রথম।তার পর থেকেই শরণ্যার পৈতে দেওয়ার চেষ্টা শুরু। কোথায় গেলে সঠিক বিধান জানা যাবে তার জন্য বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নেন। দক্ষিণ ভারতে মেয়েদের পৈতে হয় শুনে সেখানেও খোঁজ নেন। যোগাযোগ করেন কাশীর মন্দিরেও। কিন্তু করোনা অতিমারি চলতে থাকায় সেখানে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তবে আটকায়নি ইচ্ছা পূরণ। সরস্বতী পুজোর পরের দিন মাঘী ষষ্ঠী তিথিতে পৈতে হল শরণ্যার।

এক সময়ে কুশের উপবীত ধারণের চল ছিল। শরণ্যার দিদিমা ভালবেসে নাতনির জন্য সোনার উপবীত বানিয়ে দিয়েছেন। উপনয়নের দিন শাড়ি পরা শরণ্যা সেই উপবীত পরেছে। চাকরি সূত্রে শরণ্যার বাবা অংশুমান ভট্টাচার্য এখন ভিন্ রাজ্যে রয়েছেন। আর্য সমাজ মন্দিরে মাসি, মেসো, কাকা, দিদিমার উপস্থিতিতে হয় অনুষ্ঠান। বিজ্ঞানের ছাত্রী দিদিমা শিপ্রা দেবরায় বলেন, "বৈদিক যুগে সমাজে মেয়েদের যে সম্মান ও অধিকার ছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা কমে গিয়ে ছিল এক সময়। এখন মেয়েদের কোনও অংশেই কম মনে করা হয় না। আমার মা, ঠাকুর‌মাদের তো ধর্মীয়, সামাজিক কারণে লেখাপড়ার, অধিকারের প্রশ্নে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। নাতনির উপনয়নকে শুধু প্রাচীন কোনও প্রথা হিসাবে দেখছি না, ওর প্রাপ্য হিসাবে দেখছি। পৈতে শুধু ছেলেদের হবে, পরিবারের মেয়েদের হবে না, এটা আমি বিশ্বাস করি না। আজ আমি গর্বিত।’’

এত কিছু কি আর বোঝার বয়স হয়েছে শরণ্যার! ও এ সব কিছু ভাবছেও না। পৈতে হলে গুরুকুলে যেতে হয় শুনে ও বলল নিজের মন থেকে কী চায়। শরণ্যা চায়, অষ্টম শ্রেণিতে উঠলেই এনসিসি (ন্যাশনাল ক্যাডেট কপস)-তে ভর্তি হবে। আর আপাতাত ওকে অনেক নিয়ম মানতে হবে। মা, দিদিমা বলে রেখেছেন কমপক্ষে এক বছর পৈতে পরে থাকতেই হবে। সোনার পৈতে নয়, সুতোর। তার পরে ও নিজের ইচ্ছে মতো সিদ্ধান্ত নেবে। তবে এই একটা বছর অনেক নিয়ম। নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিদিন আহ্নিক করা, একাদশীতে খাওয়া-দাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ-সহ অনেক কিছু। সব নিয়ম মানার জন্য তৈরি হচ্ছে শরণ্যা। বাধ্য মেয়ের মতো বড়দের কথা মেনে চলতে তৈরি ও।

অন্য বিষয়গুলি:

Thread Ceremony Ritual
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy