সেরার মুকুট কলকাতার মাথায়।
শিল্পে নয়। সংস্কৃতিতে নয়। শিক্ষা বা খেলাতেও নয়। সারদার মতো বেআইনি লগ্নি সংস্থার কাজকারবারের হিসেবে। সাধারণ মানুষের টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে, এমন ধরনের সংস্থা সবচেয়ে বেশি রয়েছে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গেই।
এই দৌড়ে দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই তো বটেই, ভুবনেশ্বর, পটনা বা গুয়াহাটির মতো পূর্ব ও উত্তর-পূর্বের অন্যান্য শহরকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে কলকাতা। বাঙালি ব্যবসা করতে জানে না বলে এত দিন বদনাম ছিল। বাঙালি ঠিক মতো টাকাও জমাতে পারে না বলেও এ বার অভিযোগ উঠছে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসেবে, গোটা দেশে আইন মেনে নথিভুক্ত নয় ও টাকা নিয়ে টাকা ফেরত দিতে পারেনি এমন ৭০১টি সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে শুধু কলকাতায় রয়েছে ২০০টি সংস্থা। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট বলছে, ২০১১ সাল থেকে এ বছরের ২০ নভেম্বর পর্যন্ত এই সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে। বেশ কিছু সংস্থাকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কও নোটিস পাঠিয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম সারদা গোষ্ঠী। তা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের অন্য যে সব সংস্থার কাজ সেবি, ইডি বা সিবিআইয়ের আতস কাঁচের তলায় এসেছে, তাদের সকলের নামই রয়েছে এই তালিকায়। যার মধ্যে বেশ কিছু সংস্থার বিরুদ্ধে তৃণমূল সাংসদ ও শাসক দলের নেতাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে যোগাযোগ থাকার অভিযোগও রয়েছে।
লোকসভায় বিজেপি সাংসদ হেমা মালিনীর প্রশ্নের জবাবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই তালিকা আজ পেশ করেছে অর্থ মন্ত্রক। অর্থ মন্ত্রকের কর্তা থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদ, সকলেরই ধারণা পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে টাকাপয়সার বিষয়ে প্রতারণা করা খুবই সহজ। টাকা জমানোর আগে তাঁরা কোনও খোঁজখবরই নেন না। মুখের কথাই চোখ বুজে বিশ্বাস করেন। আর তাই শ’য়ে শ’য়ে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা কলকাতায় অফিস খুলে বসে মানুষকে বোকা বানাচ্ছে।
কেন পশ্চিমবঙ্গে সারদার মতো সংস্থাগুলির এই রমরমা?
অর্থনীতিবিদরা জানাচ্ছেন, এর পিছনে রয়েছে বাঙালির স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। বাঙালি টাকা জমাতে চায়। কিন্তু ব্যবসায় টাকা খাটাতে চায় না। আবার কোথায় টাকা জমানো নিরাপদ এবং লাভজনক, তা নিয়েও বাঙালি মাথা ঘামায় না। সেই কারণেই সুদীপ্ত সেনের মতো লোকেরা কলকাতায় ব্যবসা ফেঁদে বসে সহজেই মানুষকে বোকা বানাতে পারেন। কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউটের অর্থনীতির শিক্ষক অভিরূপ সরকার বলেন, “বাঙালির সঞ্চয়ের প্রবণতা বেশি, বিনিয়োগের প্রবণতা কম। তাই স্বল্প সঞ্চয়ে বরাবরই পশ্চিমবঙ্গ এগিয়ে। এ রাজ্যে ব্যাঙ্কে
যে পরিমাণ টাকা সঞ্চয় বাবদ জমা পড়ে, ঋণ নেওয়া হয় তার থেকে অনেক কম।” পাশাপাশি আর্থিক বিষয়েও এ রাজ্যের মানুষের শিক্ষা বা সচেতনতা খুব কম বলে অভিরূপের মত। তিনি বলেন, “এখানে কাউকে তিন বছরে টাকা তিন গুণ করে দেব বলে বিশ্বাস করানো খুব সহজ। বাস্তব অর্থনীতিতে তা যে সম্ভব নয়, সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।” সারদার মতো সংস্থাগুলি কলকাতায় ব্যবসা ফেঁদে কি তারই সুযোগ নিচ্ছে? অভিরূপের জবাব, “অবশ্যই। বাঙালিদের প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।”
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই তালিকা দেখে স্বাভাবিক ভাবেই চিন্তায় পড়েছেন সিবিআই কর্তারা। কারণ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, শুধু সারদা নয়, যে সব বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তাদের সকলকে নিয়েই তদন্ত করবে সিবিআই। আজই র্যামেল ইন্ড্রাস্ট্রিজ ও অ্যানেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে সিবিআই। আগে এমপিএস গ্রিনারি, আকাশদীপ, অ্যাঞ্জেল, পিএএফএল, রয়্যাল ইন্টারন্যাশনাল, উইন রিয়াল কনস্ট্রাকশন, আসডা অ্যাগ্রো-র মতো সংস্থার বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে। এই সমস্ত সংস্থার এমডি ও ডিরেক্টরদের বিরুদ্ধেই বিশ্বাসভঙ্গের মতো অপরাধ, প্রতারণা, ষড়যন্ত্র-সহ অন্য অভিযোগ আনা হয়েছে। আজ সম্প্রীতি প্রজেক্টস নামে রাজ্যের আর একটি সংস্থার বাজার থেকে টাকা তোলার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সেবি।
আজ কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চে রোজভ্যালির মামলা ওঠে। রোজভ্যালির দাবি, এ দিনের রায়ে হাইকোর্ট জানিয়েছে, সংস্থার কোনও ধরনের কাজকর্মে আপাতত হস্তক্ষেপ করতে পারবে না ইডি। কোনও সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করতে পারবে না। ইডি অফিসারদের মতে, হাইকোর্টের নির্দেশের ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে রোজভ্যালির পক্ষ থেকে। ইডি-র দাবি, শুধু রোজভ্যালির কর্তা গৌতম কুন্ডুর গ্রেফতার ও তাঁর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের উপরে এই নির্দেশ জারি করা হয়েছে। ৯ ডিসেম্বর এই মামলার আবার শুনানি হবে। রোজভ্যালির কর্মী ইউনিয়নের নেতা অমিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আইনি লড়াই চলবে।”
প্রশ্ন হল, যেখানে ২০০টি সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেখানে সিবিআইয়ের এই তদন্ত কবে শেষ হবে? সিবিআইয়ের কর্তারা বলছেন, যে সব অর্থলগ্নি সংস্থা শুধুই বেআইনি ভাবে বাজার থেকে টাকা তুলেছে, তার পর সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু সারদার মতো যে সব সংস্থার পিছনে রাজনৈতিক মদত থাকার অভিযোগ রয়েছে, সেখানে শীর্ষ আদালতের নির্দেশ মেনে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটনেই সময় লেগে যাবে।
শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ওড়িশা, অসমের মতো রাজ্যগুলিতেও বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার কাজকারবারের তদন্ত করতে হচ্ছে সিবিআইকে। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসেব বলছে, অন্য কোনও রাজ্যেই পশ্চিমবঙ্গের মতো দ্রুত বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা গজিয়ে ওঠেনি। কলকাতার সবচেয়ে কাছে গুয়াহাটি। অসমের রাজধানীতে এই ধরনের অভিযোগ উঠেছে ১০৩টি সংস্থার বিরুদ্ধে। ভুবনেশ্বর, পটনার মতো শহরে এই ধরনের সংস্থার সংখ্যা ২০ থেকে ৩০-এর মধ্যে। মুম্বইয়ে ৯৪টি বেআইনি লগ্নি সংস্থার হদিশ মিলেছে।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে সারদার মতো সংস্থার বিরুদ্ধে হাত থেকে বাঁচানোর উপায় কী? অভিরূপবাবুর দাওয়াই, ব্যাপক হারে প্রচার দরকার। রিজার্ভ ব্যাঙ্ককেই সচেতনতা বাড়ানোর কাজটি করতে হবে। সেই কাজ কি হচ্ছে? রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বক্তব্য, সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে, জেলায় জেলায় প্রচার করে, শহরের টাউন হলে অনুষ্ঠান করে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। ‘জাগো গ্রাহক জাগো’ প্রচার কর্মসূচির আওতাতেও প্রচার চলছে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সংস্থা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। রাজ্য স্তরে এ বিষয়ে সমন্বয় কমিটির মাধ্যমেও সচেতনতা বাড়ানোর কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে।
(সহ প্রতিবেদন: সুনন্দ ঘোষ)
ইডি-র কাজে খুশি মোদী
এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-র কাজে খুশি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। শুক্রবারই প্রধানমন্ত্রীর একটি শুভেচ্ছা বার্তা এসেছে কলকাতায় ইডি অফিসারদের কাছে। সেই বার্তায় এই দফতরের অফিসারেরা ‘ভাল কাজ’ করছেন বলে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন। ইডি সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবারেই ইডি-র তরফ থেকে রোজভ্যালির ২৯৫ কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়। ইতিমধ্যেই সারদার প্রায় ৭০০ কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। আগামী দিনে রোজভ্যালির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে বলেও ইডি সূত্রে জানা গিয়েছে। সূত্রের খবর, এ দিন প্রধানমন্ত্রী ফোন করেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিকে। জানান, ইডি-র পূর্বাঞ্চলের অফিসারেরা খুব ভাল কাজ করছেন। এই বার্তা ইডি-র ডিরেক্টর রাজেন কাটোচের মাধ্যমে কলকাতায় ইডি-র স্পেশ্যাল ডিরেক্টর যোগেশ গুপ্ত-র কাছে আসে। তিনিই অফিসারদের ডেকে এ দিন সে কথা জানান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy