প্রতীকী ছবি।
দামি মোটরবাইক নিয়ে ওরা যায় কোথায়?
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। ২০১৭-১৮ সাল। রাতে নিয়মিত ভাবে শিলিগুড়ির পথে টহল দিতেন পুলিশ কমিশনারেটের উপরের সারির আধিকারিকেরা। তাঁদের চোখে পড়ল কয়েক জন যুবকের অদ্ভুত গতিবিধি। রাত হলেই বাগডোগরার দিক থেকে তারা ফুলবাড়ির দিকে যাতায়াত করে দামি বাইকে। নাকা চেকিংয়ে থাকা পুলিশকর্মীদের কাছ থেকে জানা গেল, জিজ্ঞেস করলে এরা বলে, ‘হাসপাতালে যাচ্ছি’।
কয়েক দিন দেখার পরে এদের দু’-এক জনকে আটক করা হয়। দীর্ঘ জেরায় বার হয় গরু পাচার নিয়ে নতুন তথ্য। জানা যায়, বিহার থেকে সড়কপথে গরু আসে উত্তরবঙ্গে। রাজ্যে ঢোকে উত্তর দিনাজপুরের পাঞ্জিপাড়া দিয়ে। তার পরে ইসলামপুর, চোপড়া হয়ে শিলিগুড়ির গা ছুঁয়ে সেই গরু বোঝাই গাড়ি চলে যায় কোচবিহার বা অসমের দিকে। পুলিশের কর্তারা বলেন, ‘‘কিছু গরু কোচবিহার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে চলে যায়। আর কিছু চলে যায় অসম হয়ে ও পারে।’’
পুলিশ সূত্রে বলা হচ্ছে, এই গাড়িগুলির ‘রুটম্যান’ হিসেবে কাজ করে ওই যুবকেরা। বাগডোগরা-ফুলবাড়ির রাস্তায় বার বার ঘুরে তারা দেখে নেয়, কোন রাস্তা কতটা ফাঁকা, কোথায় পুলিশের নাকা কেমন। তাদের কাছ থেকে খবর গেলে ইসলামপুর বা চোপড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকগুলি এগোতে শুরু করে। পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘গোটা রাস্তায় ওরা কত টাকা ছড়ায়, ভাবতেও পারবেন না। ওই রুটম্যান পায় দশ হাজার টাকা করে।’’
আর লাভ? প্রশাসন সূত্রে খবর, এক একটি গরু বাংলাদেশে ষাট হাজার থেকে এক লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়। পুলিশ আধিকারিকদের দাবি, ধৃতদের থেকেই জানা গিয়েছে, এই ব্যবসায় তারা পুলিশ, বিএসএফ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা—সকলকেই টাকা দেয়।
মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী এনামুল হক ও বিএসএফের কমান্ডান্ট সতীশ কুমারকে নিয়ে সিবিআই নতুন করে তদন্ত শুরু করায় ফের চর্চায় চলে এসেছে শিলিগুড়ি করিডরের গল্প। সতীশ কুমার শুধু মালদহে নন, শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি এলাকাতেও এক সময় কর্মরত ছিলেন। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, সেই সময়ে তিনি মাঝে মাঝে শিলিগুড়ির দামি রেস্তরাঁ, হোটেলে একা আসতেন। বিহার থেকে তখন ওই এলাকায় কিছু লোকজনকেও আসতে দেখা যেত বলে খবর। তবে এই নিয়ে এখন কেউই মুখ খুলছেন না। তাঁদের কথায়, ‘‘সব তো সিবিআই তদন্ত করে দেখছে।’’
পুলিশ ও বিএসএফ সূত্র অবশ্য জানাচ্ছে, মালদহ-মুর্শিদাবাদের বাইরে গরু পাচারের এই রুটটি নিয়ন্ত্রণ করা হয় বিহার থেকে। মহম্মদ সরফরাজ নামে বিহারের গোপালগঞ্জের এক কিংপিন এই ব্যবসা কিছু দিন আগে পর্যন্ত চালাচ্ছিল। কয়েক মাস আগে এক দফায় সরফরাজকে অসম পুলিশ গ্রেফতারও করেছিল। বর্তমানে ওই দলের সদস্যরা তো বটেই, কিসানগঞ্জকে কেন্দ্র করে আরও একটি গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। এরা সাধারণত, বিহারের গোপালগঞ্জ, কিসানগঞ্জ, আরারিয়া, ফরবেশগঞ্জ থেকে ট্রাকে গরু চাপিয়ে জাতীয় সড়ক থেকে পাঞ্জিপাড়া হয়ে এ রাজ্যে ঢুকে ফাঁসিদেওয়া, ফুলবাড়ি, জলপাইগুড়ি চলে যায় অসমে। গুয়াহাটি, ধুবুরি এবং দক্ষিণ শালমারায় গরু নামিয়ে ওপারে পাচার চলে বলে পুলিশ ও বিএসএফ সূত্রে দাবি। তাদের আরও দাবি, তার পাশাপাশি উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুর ও চোপড়ার দেবীগঞ্জ দিয়েও গরু পাচার হয়। ওই এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বিএসএফ সাহায্য না করলে পাচার সম্ভব নয়, বলছেন প্রশাসনেরই কেউ কেউ। আবার ফাঁসিদেওয়া এবং ফুলবাড়ির দিক থেকেও পাচার হয়। তবে কোচবিহার দিয়ে পাচারের সংখ্যা এদের তুলনায় বেশি। গত বছর নভেম্বরে কোচবিহারের মাথাভাঙার ঘোকসাডাঙায় জাতীয় সড়কের পাশ থেকে ৪৯টি গরু আটক করে পুলিশ। সেখান থেকে তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়। এদের দু’জনের বাড়ি দিনহাটার বড়মরিচা, তৃতীয় জনের বাড়ি বিহারের পূর্ণিয়ায়।
পুলিশের দাবি, এ বারে লকডাউনের সময়ে এই পাচার চক্র বেশ থমকে গিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি আবার গরু নিয়ে যাতায়াত শুরু হয়েছে। কিছু দিন আগে তুফানগঞ্জের চিলাখানা ও মারুগঞ্জে দু’টি বড় গাড়ি আটক করে পুলিশ। মোট ৩১টি গরু উদ্ধার হয়। তিন জনকে গ্রেফতারও করা হয়। এদের সকলের বাড়ি কোচবিহারের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায়। পুলিশ সূত্রেই জানা গিয়েছে, সীমান্তে সাত্তার মিয়া, মজনু মিয়া ও আক্কাস মিয়ার একটি গ্যাং দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। দু’মাস আগে তুফানগঞ্জ থানার পুলিশ এদের গ্রেফতার করে। এদের সকলের বাড়িও সীমান্ত এলাকায়। এ ছাড়াও অসমের একাধিক ব্যক্তির নামও পেয়েছে পুলিশ।
পুলিশ-প্রশাসনের কথায়, একটি গাড়িতে ঠাসাঠাসি করে গরু তোলা হয়। ডাক বন্ধ করতে গরুর মুখ বেঁধে দেওয়া হয়। সীমান্তে অনেক বাড়িতে অস্থায়ী খাটাল রয়েছে। গরু রাখার জন্য সেই খাটাল ভাড়া পাওয়া যায়। সম্প্রতি তুফানগঞ্জে গরু পাচারকারীদের ধরা নিয়ে বিএসএফের সঙ্গে গ্রামবাসীদের খণ্ডযুদ্ধ বেধে যায়। সীমান্তের কাছে যাঁরা থাকেন, তাঁদের কথায়, রাতে মাঝে মাঝেই ‘লোডশেডিং’ হয়ে যায়। সেই অন্ধকারের ফাঁক গলে পাচার চলে। সুতরাং গোটা চক্রের সঙ্গে কারা যে যুক্ত এবং কারা নয়, তা বেছে ওঠা খুব কঠিন।
এই পাচার চক্রের টাকা কোথায় যায়? লোকমুখে একাধিক প্রভাবশালীর নাম ঘোরে। কেউ জেলার, কেউ কলকাতার। কেউ বা অন্য কোনও জায়গার। কোচবিহারের বিজেপি সাংসদ নিশীথ প্রামাণিক বলেন, ‘‘আমি কয়েক দিন আগেই বিষয়টি সংসদে তুলেছি। সিবিআই ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাচারচক্রের প্রত্যেককে ধরতে হবে।’’ তৃণমূলের কোচবিহার জেলা সভাপতি পার্থপ্রতিম রায় বলেন, ‘‘আমরা বার বার বলছি, এই পাচারের বিরুদ্ধে যারা যুক্ত, প্রত্যেককেই গ্রেফতার করতে হবে। আর সীমান্ত পাহারার দায়িত্ব রয়েছে বিএসএফ। তার পরেও কী করে সীমান্তে এই কারবার চলে, তা খতিয়ে দেখা দরকার।’’ বিএসএফের উত্তরবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের আইজি এস কে ত্যাগী অবশ্য বলেন, ‘‘এ সব আমাদের সংশ্লিষ্ট বিষয় নয়। এ নিয়ে কিছু বলব না।’’ রাজ্য পুলিশের উত্তরবঙ্গের আইজি বিশাল গর্গকে একাধিক বার ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। মেসেজের উত্তরও দেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy