Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Durga Puja 2022

মঞ্চে থাকে দুর্গার‘কাটিং’, শিল্পী দূরেই

সাত-পাঁচ ভাবতে না ভাবতেই ছিপছিপে স্কুটার বাহনে আবির্ভাব অপরূপা যুবার। বয়স বড়জোর কুড়ি। সরু ভুরুর একটায় কেতার স্লিট। বড় বড় পাতায় ঘেরা দু’চোখ, সরল এবং তীক্ষ্ণ।

মঙ্গলচণ্ডী প্রতিমা গড়ছে মংলু। ছবি: বিকাশ সাহা

মঙ্গলচণ্ডী প্রতিমা গড়ছে মংলু। ছবি: বিকাশ সাহা

সোহিনী মজুমদার
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৯:১৫
Share: Save:

তেজপাতা বাগানের উল্টো দিকে একতলা বাড়ির রোয়াক। এখানে অপেক্ষা করাই যায়।

মংলু, খনের গান করে... পালাগান— এই বললে কেউই ঠাহর করতে পারছেন না। যে ফোন নম্বরটা সম্বল, ডায়াল করলে চালাক-ফোনের অ্যাপ্লিকেশন ইন্টারনেট-খুঁড়ে বলছে, নাম রিয়া। সাজগোজ করা একটা মুখের ছবিও দেখাচ্ছে— কপালে সম্ভবত সিঁদুর।

সাত-পাঁচ ভাবতে না ভাবতেই ছিপছিপে স্কুটার বাহনে আবির্ভাব অপরূপা যুবার। বয়স বড়জোর কুড়ি। সরু ভুরুর একটায় কেতার স্লিট। বড় বড় পাতায় ঘেরা দু’চোখ, সরল এবং তীক্ষ্ণ। দু’কানে তিনটে করে পাতলা দুল। ছোট্ট লকেট ঝুলছে গলার কালো পুঁতির মালায়। পিছনে চুড়ো করে ক্লাচারে বেঁধে রাখা এক ঢাল চুল। বলল, ‘‘এসো গো!’’ বলে বোঁ করে

মংলু হাওয়া হয়ে গেল। আর আমরা খেতের ধারে কাদা মাটির খন্দ-পথে নাকানিচোবানি খেতে খেতে পৌঁছলাম টিনের ছাউনি দেওয়া মাটির ঘরটায়।

ছোটবেলায় কীর্তন আর খনের আসরে গান গাওয়া শুরু মংলুর। মংলুর জেঠিমা বলেন, ‘‘লেখাপড়া বেশি করবে কী করে? ওই গান আর প্রতিমা তৈরিই তো ওর জীবন!’’ শহর থেকে তো লোক আসেনি আগে কখনও! পুজো-বাড়িতে মঙ্গলচণ্ডী প্রতিমায় মাটি লেপার কাজটুকু গুটিয়েই তাই ছুটতে ছুটতে মংলু এসেছে। ফাংশনে ব্যস্ত থাকায় দুর্গা প্রতিমার বরাত অবশ্য এ বছর মেলেনি।

দুর্গাপুজোর সঙ্গে তেমন যেন প্রাণের যোগ নেই উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জের ধনকৈল পঞ্চায়েতের এই প্রাচীন রাজবংশী পাড়ার। ছিড়ামতি (শ্রীমতী) নদীর ‘গুরগুরি বান’ উথলি পড়লে পাড়ে পুঠি, ডেনকা, চেং, মাগুর মাছ ‘নাফানাফি’ করে। আটিশরের ঝার জঙ্গলে সন্ন্যাসী থানে দুর্গা, চণ্ডী, চামুণ্ডা, কালী আর মা ধরতির নামে আছে পাঁচটা ঢিপি। ‘তেল, সিন্দুর, তুলসী, দুর্বা, পঞ্চশস্য’ দিয়ে তার পুজো হয়। চিনি, বাতাসা ভোগ। পান, সুপারি রেখে ধূপ দেওয়া হয়। উপচার এটুকুই। গারস্তির মঙ্গল কামনায়, ভাল ফসল ওঠার আশায় চৈত সংক্রান্তির ছেড়ু আই খেলা, গচিপন ব্রত, নক্ষীর ডাক, হকলোই ব্রতই এই জনপদের উৎসব।

ফসল পাহারা দেয় ছেবু আনে (অপদেবতা), মাছেদের সর্দার মশনা। মনসা, সত্যপীর, নড়বড়িয়া শিবের মতোই মান্যি করতে হয় তাদেরও। ঘুটঘুট আন্ধার বাঁশবাড়িতে শিমোল গাছের ‘ঠুটা মাথা আর বুকত চোখ মশান কালি ভূত’ হয়ে যায় ঘরের নোক। এই জীবনযাপনেরই অঙ্গ খনগান। এখানকার রোদ-হাওয়ায় না মিশলে, গতরে না খাটলে ওই সুর তৈরি করা যায় না, বললেন প্রবীণ খন পালাকার খুশী সরকার।

গ্রামে নতুন সাইকেল এল, পাম্প বসল, হ্যাজাকের চল হল। ‘সাইকেলশোরী’, ‘পাম্পিংশোরী’ বা ‘হ্যাজাকশোরী’ নামে তারাই হয়ে উঠল চরিত্র—খন পালার ‘নায়িকানি’। জীবনের ছোট ছোট উত্তেজক কাণ্ড, ক্ষণ বা খণ্ডচিত্র নিয়ে ‘শাস্তোরি’ বা ‘কিস্সা’ খন পালা বেঁধে ফেলেন ‘গাউন’-রা। ‘সতী-হেবলা’র মতো পালায় আলাভোলা স্বামীকে নিয়ে সতীর জীবনের দুঃখ কৈলাসবাসিনীর কথা মনে পড়ালেও সেই ভাষা শহরে পূজিত গিরিরাজনন্দিনীকে ছুঁতে পারে না। সেই ঐশ্বর্যকে মাটির রূপ দিয়ে দুই সংস্কৃতির যোগসূত্র রক্ষা করে চলে মংলুদের মতো জনাকয়েক।

তবে খনের পালা আগের মতো তেমন ‌জমে না। তাই বিহার-অসমে ‘শর্ট ড্রেস’ বা লেহঙ্গায় ভোজপুরি গানের ঠমকে লাস্যময়ী ওঠেন রিয়া, ওরফে খনের নায়িকানি মংলু। দু’পয়সা রোজগার হয়। শিল্পীভাতা তো জোটেনি। ‘‘ঘুষ না দিলে জোটে না’’, বললেন পাশের গ্রাম গোপালপুরের বছর পঁয়তাল্লিশের আর এক নায়িকানি দুলাল প্রধান।

খনে ‘ছুকরি’ সাজতেন মংলুর বাবা বাবলুও। তাই ছেলে কেন চুড়িদার, মেকআপে ‘মেয়েছেলের’ মতো সাজতে ভালবাসে, তা নিয়ে অস্বস্তি নেই তাঁদের মনে। অভাবের সংসারে সেই কোন কালে গান ছাড়তে হয়েছে। সাধাসাধির পরে, চোখ নামিয়ে লাজুক হেসে গেয়ে ওঠেন, ‘কী করেছে মিনতিক বেটি তুই ঘরেগে বসিয়া/ হয়াছে ইশকুলের বেলা, যা না গে পড়িবা।’ পাশ থেকে তখন বাহবা দিয়ে যাচ্ছেন তাঁর বৌদি, ছেলের বৌরা। ছুকরি সাজার জন্য দুলালকে অবশ্য একটু কথা শুনতে হয় ইশকুলে পড়া মেয়ের কাছে।

কথা এমন অনেক শুনতে হয়েছিল। একঘরে হয়েছিলেন প্রথম যুগের মহিলা খন-নায়িকানি, দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমণ্ডির আকুলবালা সরকার, মমতা বৈশ্যরা। বয়স সত্তর পেরিয়েছে। ঋজু শরীরে এখনও দুর্গা-বেশে ইউনেস্কোকে ধন্যবাদজ্ঞাপনের অনুষ্ঠান করে এসেছেন আকুলবালা। তবে দুর্গার ওই ‘কাটিং’ বা সাজটাই কেবল দুর্গাপুজো-কেন্দ্রিক অনুষ্ঠানে থাকে, তার পরেই শুরু হয়ে যায় জনপ্রিয় ‘হালুয়া-হালুয়ানি’র (হাল চষেন যাঁরা) পালা।

বড় উৎসব, অনেক জৌলুসে অচেনা লাগে ওঁদের। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের স্মৃতি ভাসে। খন প্রচারের উদ্দেশ্যে কোনও এক দুর্গাপুজোতেই কলকাতায় কিশোরী মমতা-আকুলবালাদের নিয়ে আসেন এক অধ্যাপক। অনুষ্ঠানের পরে এক পয়সাও না দিয়ে থালা হাতে ধরিয়ে দেন তিনি। স্টেশনে, রাস্তায় গান গেয়ে ভিক্ষে করে সপ্তাহ খানেক পরে ঘরে ফিরতে হয়েছিল।

তাই মঞ্চেও সপরিবার ‌দুগ্গা ঠাকুরের ‘কাটিং’টাই শুধু থেকে যায়। প্রান্তজনের শিল্পের অন্দরে প্রবেশ করতে পারে না মহিষাসুরমর্দিনীর পরাক্রম। দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকেন শিল্পী। ডিঙোতে পারেন না নাটমন্দিরের চৌকাঠ।

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja 2022 Boy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy