ভাঙড়ের বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি এবং প্রাক্তন বিধায়ক আরাবুল ইসলাম। ফাইল ছবি।
মাস কয়েক আগে কলকাতার রাস্তা থেকে তাঁকে গ্রেফতার করেছিল রাজ্য পুলিশ। তার ঠিক দু’দিনের মাথায় ভাঙড়ের বিধায়ক তথা ইন্ডিয়ান সেকুলার ফন্টের (আইএসএফ) নেতা নওশাদ সিদ্দিকির মুক্তি চেয়ে মিছিল নেমেছিল কলকাতায়। ব্যস্ত বিকেলে সেই মিছিলের ধাক্কায় হঠাৎ থমকে গিয়েছিল মহানগরের রাস্তা। স্লোগান উঠেছিল শাসকদলের বিরুদ্ধে। শাসক বা মূল বিরোধী দলের প্রতিনিধি না হয়েও জনপ্রিয়তায় বড় নেতাদের টক্কর দেওয়া সেই নওশাদ কিন্তু পঞ্চায়েতে নিজের মান রাখতে পারলেন না। যে ভাঙড়ে দু’বছর আগে শাসকদলকে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন, সেই ভাঙড়েই পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভরাডুবি হল তাঁর। শাসকদলের দাপুটে জয়ের মুখে খাতা খুলতে পারল না ভাঙড়ের ভাইজানের দল আইএসএফ। ১৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ভাঙড়ে তৃণমূলের দখলে এল ১৮টি। আইএসএফ জমিরক্ষা কমিটির জোট পেল একটি মাত্র পঞ্চায়েত। অন্য দিকে, সম্মান রক্ষার লড়াইয়ে শাসক তৃণমূল সেঞ্চুরি হাঁকাতে গিয়েও পারল না ভাঙড়ে। প্রাক্তন বিধায়ক তথা তৃণমূলের ‘তাজা নেতা’ বলে পরিচিত আরাবুল ইসলামের খাসতালুকেই পঞ্চায়েত ভোটে হারল তৃণমূল। যা একেবারেই ভাবা যায়নি। ভাঙড়ের পঞ্চায়েতে এই ফল দেখে অনেকেই বলছেন, ভাঙড় যেন এক অদৃশ্য দাঁড়িপাল্লা। যার এক পাল্লায় জয় থাকলেও অন্য পাল্লায় রয়েছে কাঁটা খচখচানো হার।
পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণার অনেক আগে থেকেই ভাঙড় নানা কারণে আলোচনায়। কখনও আরাবুলের সঙ্গে নওশাদের সংঘাত, কখনও ভাঙড়ের বিধায়ক নওশাদের গাড়িতে ভাঙচুড়। এর পরে আরাবুলের গ্রেফতারির দাবিতে কলকাতায় আইএসএফের বিক্ষোভ এবং নওশাদের গ্রেফতারি। প্রায় ৪০ দিন বন্দি ছিলেন আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ। ভাঙড়ের লড়াইটা তার পরে অনেকটাই হয়ে উঠেছিল আরাবুল বনাম নওশাদের। মঙ্গলবার সেই যুদ্ধের ফলঘোষণার পর মলিন মুখে হার মেনে নিয়ে গণনাকেন্দ্র ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন আরাবুল। আর হেরে গিয়েও নওশাদ বললেন, ‘‘মনোনয়ন পর্ব থেকে আরম্ভ করে ভোট পর্বে এবং গণনা পর্বেও শাসকদল সন্ত্রাস চালিয়েছে ৷ বিরোধী এজেন্টদের বসতে দেয়নি ৷ আইএসএফ সেই সন্ত্রাস এবং হুমকি উপেক্ষা করেও ভাল ফল করেছে।’’
পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণার পর ভাঙড়ের অশান্তি অন্য রূপ নেয়। বোমাবাজি, গুলি সংঘর্ষ একের পর এক মৃত্যু— শুধু মনোনয়ন পর্বেই তিন জনের মৃত্যু হয় ভাঙড়ে। তবে মৃতদের মধ্যে এক জন আইএসএফ কর্মী হলেও দু’জন তৃণমূল কর্মী ছিলেন। আহতও হন দু’পক্ষের অনেকে। কিন্তু নতুন সমস্যা দেখা দেয় মনোনয়ন পর্ব শেষ হওয়ার পর। দেখা যায় বহু বুথে মনোনয়ন জমা দিতেই পারেননি আইএসএফ। আবার যাঁরা মনোনয়ন জমা দিতে পেরেছিলেন, তাঁদের অনেকেরই নাম মুছে গিয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তালিকা থেকে। ৮২ জন আইএসএফ প্রার্থী এবং বহু সিপিএম প্রার্থী নিজেদের নাম কমিশনের তালিকায় খুঁজে না পেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন। কিন্তু আদালতে তাঁদের নতুন করে মনোনয়ন জমা দেওয়ার সুযোগ খারিজ করে দেয়। ফলে ভাঙড়ে বহু আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যায় তৃণমূল।
ভাঙড়ে মোট দু’টি ব্লক— ভাঙড় ১ এবং ভাঙড় ২-এ যথাক্রমে ন’টি এবং ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েত। এর মধ্যে ভাঙড় ১-এর সমস্ত ন’টি পঞ্চায়েতে ভোটই হয়নি। ভোট হয়নি ভাঙড় ১-এর ২৭টি পঞ্চায়েত সমিতিতেও। সর্বত্রই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়েছে তৃণমূল। অন্য দিকে, ভাঙড় ২ ব্লকের ৩০টি পঞ্চায়েত সমিতির আসনের ১৪টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যায় তৃণমূল। লড়াই হয় বাকি ১৬টিতে। এর মধ্যে পাঁচটি আসন পেয়েছে আইএসএফ। জমিরক্ষা কমিটি পেয়েছে তিনটি। বাকি আটটি পেয়েছে তৃণমূল। ভাঙড় ১ এবং ভাঙড় ২ মিলিয়ে জেলা পরিষদ ছিল ৬টি। এর মধ্যে দু’টিতে তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতে। বাকি চারটি আসনে লড়াই হয়। তার মধ্যে একটি জিতেছে আইএসএফ বাকি তিনটি তৃণমূল পেয়েছে। ভাঙড় ২-এর ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েতেরও অধিকাংশ আসনে তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতে। ভাঙড় ২-এর প্রায় প্রতিটি পঞ্চায়েতেই কোথাও আট, কোথাও ১০, কোথাও বা তারও বেশি আসনে বিনা লড়াইয়ে জয়ী হন তৃণমূল প্রার্থীরা। তার পরও অবশ্য কয়েকটি আসনে বিশেষ নজর ছিল। যে আসনগুলিতে তৃণমূলকে লড়াই করতে হত। তারই মধ্যে একটি ছিল আরাবুলের গ্রাম পোলেরহাট ২ এবং আইএসএফের শক্ত ঘাঁটি চালতাবেড়িয়া। চালতাবেড়িয়ায় ৩০টি আসনের মধ্যে ন’টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিল তৃণমূল। লড়াই হয় ২১টি আসনে। গণনা শেষে দেখা যায় ১৭টি আসনে তৃণমূল জিতেছে সেখানে। নওশাদের দল পেয়েছে ১২টি আসন। নির্দল একটি। অন্য দিকে, পোলেরহাট ২-এ লড়াই ছিল ২৪টি আসনের মধ্যে ২৪টিতেই। ভাঙড় ২ ব্লকের এই একটি পঞ্চায়েতে একটিও আসনে আগাম জেতেনি তৃণমূল। গণনা শেষে দেখা যায় শাসকদলের হাতে রয়েছে একটি মাত্র আসন। সেটিও শুধুমাত্র আরাবুলের বুথ। বাকি আরাবুলের গ্রামের ২৩টি আসনের মধ্যে ২২টিতেই জিতেছে জমিরক্ষা কমিটি এবং আইএসএফের জোট। একটি আসনে একা জেতে আইএসএফ। অর্থাৎ যে সমস্ত আসনে লড়াই হয়েছে, তা জেলা পরিষদ হোক বা পঞ্চায়েত সমিতি কিংবা গ্রাম পঞ্চায়েতের আসন, তৃণমূল একছত্র ভাবে জেতেনি। বরং বিরোধীরা অনেক জায়গাতেই জিতেছে।
মঙ্গলবার লড়াই করেও হারার হতাশার স্পষ্ট ছাপ দেখা যায় তৃণমূল নেতা আরাবুলের কথায়। শোনা গিয়েছিল এ বারের পঞ্চায়েত ভোটে দল তাঁকে আলাদা করে দায়িত্ব না দিলেও ভাঙড়ের তৃণমূল নেতা নাকি নিজের মতো পরিকল্পনা সাজিয়েছিলেন। মনোনয়নের আগে এ-ও বলেছিলেন, তাঁরা সন্ত্রাস করবেন না কিন্তু কেউ যদি হামলা করেন, তবে তাঁরা হামলাকারীদের পরীক্ষা নেবেন। মঙ্গলবার সঙ্গীদের নিয়ে গণনা চলাকালীন পোলেরহাট স্কুলে অপেক্ষা করছিলেন আরাবুল। কিন্তু তিনি গণনা শেষের আগেই বুঝে যান, হারতে চলেছেন। আগাম হার স্বীকার করে গণনাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। উপস্থিত সাংবাদিকেরা তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কেন তিনি হঠাৎ চলে যাচ্ছেন? জবাবে আরাবুল বলেন, ‘‘আমার বুথে জিতেছি। কিন্তু পোলেরহাট ২-এর অন্য বুথগুলোয় হেরেছি। কোথাও পাঁচ কোথাও সাত কোথাও ১০ ভোটে হেরেছে আমাদের প্রার্থীরা। আমাদের সাত জন প্রার্থী শুধুমাত্র ৫-১৫ ভোটে হেরেছে।’’ কিছুটা আক্ষেপের সুরেই আরাবুল এর পর বলেন, ‘‘এই অবস্থা। কী আর করার আছে। হতেই পারে। কিন্তু ১০টা গ্রাম পঞ্চায়েতের বাকি ন’টা তৃণমূলেরই দখলে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy