পাল্টে গিয়েছে। বদলেছে প্রায় সবই। মাঝখানের সময়টা টেনেটুনে ধরলে বছর দশেকও হবে না।
মফস্সল শহরগুলোতে তখন সিনেমা হল ছিল। লুকিয়েচুরিয়ে ছিল ভিডিও হল-ও। আদর করে ডাকা হত ভিডিও পার্লার। ছিল নির্ভেজাল দেবযান ভ্যান-রিকশা। শহরগুলোর মানচিত্রের ভেতর অল্প অল্প করে বাঁচিয়ে রাখা ছিল পুকুর, লিচুবাগান, আমবাগান, কোথাও বা আবার ছোট্ট অথচ আস্ত একটা ধানের খেত। গুগ্ল ম্যাপ বা উইকিম্যাপিয়া তখনও নজরবন্দি করে উঠতে পারেনি তাদের। এ সবের সঙ্গেই কোথাও কোথাও ছিল রেলস্টেশন। আর যেখানে রেলস্টেশন নেই, সেখানে ছিল বাসস্ট্যান্ড। এ সবের অনেক কিছুই নেই। আবার অনেক কিছু আছে। তবে পরিবর্তন এসেছে সবেতেই।
পাল্টে যাওয়া সেই মফস্সলে গরমের মরসুমে জামাইদের নিয়ে আহ্লাদের জামাইষষ্ঠীতেও বদল এসেছে। কেমন সেই বদল?
বছর দশেক আগেও ষষ্ঠীর দু’এক দিন আগে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে যেতেন জামাইদের অনেকেই। আনকোরা জামাইদের সংখ্যাও কম ছিল না। বিয়ের সদ্য আড়-ভাঙা সেই সব মেয়ে-জামাইদের দেখে বোঝাও যেত, তারা নতুন। জামাইয়ের বাড়ি যদি শহরে হয় তবে তার কাছে এটা ছিল একটা আউটিং। আর গ্রামের ছেলের কাছে এই মফস্সল জীবনে ছিল শহরবাসের অনুভূতি। স্টেশনে বা বাসস্ট্যান্ডে নেমে জামাইরা মেয়ে-বাচ্চাকে পাড়ি দিত গ্রামের পথে। গ্রাম থেকেও প্রচুর মেয়ে-জামাই রওনা হত শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশে। সেই একই পথে। একই ভাবে। কারও কারও যাত্রা আবার থেমে যেত সেই সব মফস্সল শহরেই। কেননা বৌয়ের বাপের বাড়ি সেখানেই যে! অনেক সময় দেখা যেত একই পরিবারের একাধিক জামাই নেমেছে স্টেশনে। ভায়রাভাইদের সেই দঙ্গলে স্টেশন থেকেই পিছু নিত তাদের শ্যালকেরা।
পাড়ার মোড়ে এ সব নিয়ে জোর জল্পনা চলত। চায়ের গুমটি বা ক্লাবে চলত গল্পগুজব। যে বাড়িতে ঘটা করে ষষ্ঠীর আয়োজন হত, সে বাড়িতে তখনও যদি কোনও অবিবাহিত মেয়ে থাকত, আলোচনায় তার সমবয়সি বা একটু বড়দের হা-হুতাশে উঠে আসত সে কথা। ও বাড়ির জামাইয়ের ভায়রাভাই হওয়ার আকুতি মিশে যেত সেই আলোচনায়। তারও অনেক আগে থেকেই এই সব জায়গায় চলতি ছিল পাঁচটি শব্দের এক বাক্য— এখানে জামাই ভাড়া পাওয়া যায়। মূলত মজা, তবে কেউ কেউ ভাড়াটে জামাই হতেও রাজি ছিল।
একটা একটা পরিবার ছিল, যেখানে জামাই-মেয়েদের নিয়ে মোট সংখ্যাটা কুড়ি ছাড়িয়ে যেত। হাতে গোনা কয়েকটি বাড়িতে তারও বেশি হত। সেখানে এই আয়োজন সামলাতে পাড়ার কাজ-করিয়ে দু’এক জন উত্সাহী ছেলেকেও নেমন্তন্ন করা হত। তারাও মেয়েদের দাদা বা ভাই হিসেবে নিজেকে উজাড় করে দিতে পিছপা হত না। সকালে লুচি-আলুর তরকারি থেকে দুপুরের খাসির মাংস-সহ অনেক পদ খেয়েদেয়ে বিকেলের সিনেমা এবং রাতের খাবার খেয়ে তবেই বাড়ি ফিরত এই সব উদ্যমীরা। বিকেলে ক্লাবের মাঠে মাঝে মাঝে ফুটবল খেলাতেও অংশ নিত জামাইয়েরা।
অনেক পরিবারই আগে থেকে সিনেমা হলের ব্ল্যাকারদের সঙ্গে কথা বলে একটা বা দু’টো ‘রো’ বুক করে রাখত। কারণ জামাইষষ্ঠী এবং ঈদের দিন সিনেমা হলগুলোতে মাছি গলার জায়গা ছিল না। দিনের দিন টিকিট পাওয়ার কোনও ব্যাপার তো ছিলই না, উল্টে কয়েক দিন আগে থেকেই বলে রাখতে হত তাদের। সঙ্গে দিতে হত প্রায় তিন গুন টাকা। তখন এই সব সিনেমা হলগুলোতে দশ টাকার মধ্যে প্রথমশ্রেণি এবং ব্যালকনির টিকিট পাওয়া যেত। তবে, যারা সেই টিকিট জোগাড় করতে ব্যর্থ হত, তাদের ভরসা ছিল ভিডিও পার্লার। সেখান থেকে টিভি, ভিসিপি এবং ক্যাসেট নিয়ে বাড়িতেই বসে যেত সিনেমা হলের আসর। তেজাব থেকে মুকাদ্দর কা সিকান্দর বা শাহেনশা আর সঙ্গে গুরুদক্ষিণা বা বেদের মেয়ে জ্যোত্স্না। তবে কোনও কোনও বাড়িতে ঋত্বিক, সত্যজিত্ বা অপর্ণা সেন যেতেন। কিন্তু, সব জায়গার পার্লারে তাঁরা থাকতেন না। অগত্যা যা পাওয়া যায়!
এই যা পাওয়া যায়-এর ভিড়ে মাঝে মাঝে চোরাগোপ্তা ভাবে ঢুকে যেত দু’একটা অন্য সিনেমার ক্যাসেট। সেই সব নীল ছবি বড়ই সাহস করে দেখা হত রাতে। তবে যে জামাইয়ের ঘরে টিভি-ভিসিপি রাখা হত, তিনিই হয়তো সস্ত্রীক লুকিয়েচুরিয়ে সেই সুযোগ পেতেন। বহুবচনের কোনও জায়গা ছিল না সে কথা হলফ করে বলাই যায়। এ সব তথ্য জামাইষষ্ঠীর পর বেরিয়ে পড়ত সংশ্লিষ্ট পার্লারের কর্মচারীর কাছ থেকে। কোন বাড়িতে কতগুলি ক্যাসেট দেখা হল, ক্লাবের আলোচনায় পরের কয়েক দিন সেই কথাই ঘুরেফিরে আসত।
আবার ফোকটে মিষ্টি খাওয়ার দৃশ্যও মফস্সল দেখেছে।
সিল্কের পাঞ্জাবির নীচে পাটভাঙা ধুতি পরে স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসছে জামাই। আর তাঁর স্ত্রী। নতুন দম্পতি হবে হয়তো। ঘোরতর গরম। জৈষ্ঠ্যের রোদ্দুর রেহাই দিচ্ছে না কাউকে। তার মধ্যে ওই সিল্কের পাঞ্জাবিকে দেখে ব্যাঙ্গাত্বক কয়েকটা মন্তব্য উড়ে এল। জামাই নির্বিকার। স্টেশনের বাইরের দোকান থেকে দু’ হাঁড়ি মিষ্টি কেনা হল। সবাই নজরে আসছে, চায়ের দোকানে আড্ডা দেওয়া ছেলেছোকরাদের। সবাই জানে, এ বার ভ্যানে চেপে গ্রামের পথে চলে যাবে ওই দম্পতি। ভ্যান ডাকল জামাই। বৌকে ভ্যানে চড়িয়ে তার হাতে একটা হাঁড়ি ধরিয়ে আর একটা নিয়ে এ বার চায়ের দোকানের দিকে এগোল সে। সামনে থাকা ছেলেটার হাতে সেই হাঁড়িটা ধরিয়ে দিয়ে এক গাল হেসে বলেছিল সে, ‘‘শালাবাবু, এটা তোমাদের জন্য।’’ আর কোনও মন্তব্য ওড়েনি।
আর এখন?
এখনও জামাইরা আসে। সিল্কের পাঞ্জাবি পরা জামাই এখনও ৩৫-৩৭ ডিগ্রির মফস্সলে দেখা যায়। এখনও লোকাল ট্রেনে মেয়ে-জামাইদের ভিড় হয়। তবে কোথাও যেন সমাজের বাকি অংশের সঙ্গে তার যোগ কমে গিয়েছে। বাজারে জামাইষষ্ঠীর সকালে ভিড় দেখলে চোখে তাক লেগে যাবে। মিষ্টির দোকানে আজও সাতসকালে শেষ হয়ে যায় সব। ফাঁকা ট্রে দেখে মাছিরাও ভনভন করতে ভুলে যায়। তবু কোথাও যেন, জামাইষষ্ঠীর সামাজিক অবস্থান বদলে গিয়েছে। ভুরিভোজ শুধু পারিবারিক স্তরেই আটকে গিয়েছে। তা নিয়ে পাড়ায় কোথাও কোনও আলোচনা হয় না। সিনেমা হলের বদলে সন্ধের রেস্তোরাঁতে বা বিকেলের পার্কে ভিড় জমে। তবে, পাড়ার ফুচকাওয়ালার পোয়াবারো দশা আজও কাটেনি। পাড়াতুতো শ্যালকদের সঙ্গে জামাইদের কথাবার্তাও আজকাল আর বিশেষ হয় না।
পাল্টেছে অনেক কিছুই। স্টেশনে নামা ঘামে ভেজা সেই সিল্কের সিক্ত পাঞ্জাবি বা পরনের ছোট হয়ে আসা পাজামা পরা জামাই আর দেখা যায় না। এখন সবই ব্র্যান্ডের খেলা। ভ্যানরিকশা নয় অনেক জামাই এখন গাড়ি ভাড়া করে শ্বশুরবাড়ি আসে। অনেকে আবার সপ্তাহের মাঝে ষষ্ঠী পড়লে আসে না সেটা পাল্টে গিয়েছে উইকএন্ড-এ। স্টেশনের উল্টো দিকে রাস্তার পাশে চায়ের গুমটিতে বসে থাকা চেহারাগুলোর পরিবর্তন হয়েছে। মুখগুলো পাল্টেছে। তবে, এখনও সেখানে এ ওকে ঠেলে বলে, ‘‘ওই দেখ রে, জামাই নামল।’’ পাল্টায়নি এটুকুই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy