চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনে পুলিশের পদক্ষেপকে ধিক্কার দিলেন বিশিষ্টরা। গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
অনশনরত টেট চাকরিপ্রার্থীদের ‘বলপ্রয়োগ’ করে আন্দোলনস্থল থেকে উৎখাত করার ঘটনার সমালোচনা করলেন রাজ্যের বিশিষ্টদের একাংশ। বৃহস্পতিবার রাতে বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ আন্দোলনরত চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনস্থল থেকে তুলে দেয়। রাত থেকেই বিভিন্ন নেটমাধ্যমে এ বিষয়ে পোস্ট করতে শুরু করেছিলেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের নাগরিকেরা। যার স্রোত শুক্রবারেও জারি আছে। তারই পাশাপাশি শুক্রবার বিশিষ্টদের একাংশ একটি খোলা চিঠি লিখে ঘটনাপ্রবাহের নিন্দা করেছেন।
বিশিষ্টদের চিঠিতে লেখা হয়েছে, ‘সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখেছি যে, অনশনরত চাকরিপ্রার্থীদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য কী ভাবে বিধাননগর পুলিশ বলপ্রয়োগ করে তাদের আন্দোলনকে ভাঙার চেষ্টা করেছে। এই ঘটনাকে আমরা ধিক্কার জানাই। এবং পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ বলে মনে করি।’
রাজ্য সরকারকে উদ্দেশ্য করে লেখা ওই খোলা চিঠিতে সই করেছেন বিনায়ক সেন, অপর্ণা সেন, চিকিৎসক কুণাল সরকার, নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তী, সুমন মুখোপাধ্যায়, সুজন মুখোপাধ্যায়, বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য, রেশমী সেন, কৌশিক সেন, ঋদ্ধি সেন প্রমুখ। প্রসঙ্গত, ওই খোলা চিঠিতে সই করা ছাড়াও অপর্ণা শুক্রবার সকালেই একটি টুইট করে ওই ঘটনার কড়া নিন্দা করেছিলেন। ফেসবুকে ‘ধিক্কার’ জানান ঋদ্ধি।
প্রসঙ্গত, এঁদের মধ্যে অপর্ণা, সুমন, কৌশিকদের মুখ ‘পরিবর্তন’-এর হোর্ডিংয়ে দেখা গিয়েছিল। রাজ্যে সাড়ে তিন দশকের বামশাসনের অবসান চেয়ে তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভোট দেওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে। তার পর অবশ্য বিভিন্ন প্রশ্নে এঁদের সঙ্গে মমতার ‘দূরত্ব’ তৈরি হয়েছে। আবার অনেকের সঙ্গে হয়ওনি। তাঁরা মমতার ‘ঘনিষ্ঠ’ বৃত্তেই থেকে গিয়েছেন। প্রত্যাশিত ভাবেই, এমন কারও সই ওই খোলা চিঠিতে নেই, যাঁরা রাজ্য সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতার ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত।
বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশি পদক্ষেপের সমালোচনা করে খোলা চিঠিটিতে লেখা হয়েছে, ‘এই ঘটনাকে আমরা ধিক্কার জানাই।’ তাঁরা জানিয়েছেন, ঘটনাটি রাজ্যের সাধারণ নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ। পাশাপাশিই তাঁরা রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মেটানো হোক। আন্দোলনকারীদের মধ্যে যাঁরা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে যেন ফৌজদারি মামলা দায়ের করা না হয়।
প্রাথমিকের শিক্ষক হিসাবে সরাসরি নিয়োগের দাবিতে গত সোমবার থেকে সল্টলেকে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের অদূরে অনশন-আন্দোলন করছিলেন ২০১৪ সালের টেট চাকরিপ্রার্থীরা। তাঁদের দাবি ছিল, যে হেতু তাঁরা টেট উত্তীর্ণ এবং দু’বার ইন্টারভিউও দিয়েছেন, তাই পর্ষদ তাঁদের এ বার সরাসরি চাকরির নিয়োগপত্র দিক। যদিও পর্ষদের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়, সরাসরি নিয়োগপত্র দেওয়া হবে না। ঘটনাচক্রে, বৃহস্পতিবার থেকে ওই আন্দোলনস্থলের অদূরে আরও একটি অবস্থান শুরু করেন ২০১৭ সালের টেট উত্তীর্ণেরা।
ওই অবস্থান-আন্দোলনের ফলে পর্ষদের কর্মীদের কাজে যেতে অসুবিধা হচ্ছে জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করেছিল পর্ষদ। বিচারালয় রায় দেয়, পর্ষদকর্মীদের যাতে দফতরে ঢুকতে-বেরোতে কোনও অসুবিধা না হয়, তার জন্য রাজ্য সরকারকে আন্দোলনস্থলে পুলিশ মোতায়েন করতে হবে। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে পর্ষদ বলেছিল, ওই আন্দোলনে তাদের দৈনিক কাজে সমস্যা হচ্ছে। তার প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তিকালীন নির্দেশে আদালত বলেছিল, আন্দোলনস্থলে পুলিশ মোতায়েন করতে। যাতে আন্দোলনকারীদের বাধা পেরিয়ে পর্ষদের কর্মীরা তাঁদের অফিসে ঢুকতে পারেন। পাশাপাশি, রাজ্যের ১৪৪ ধারা জারি করার আর্জিটিও নির্দেশে উল্লেখ করেছিল কলকাতা হাই কোর্ট।
বিশিষ্টদের চিঠিতে ১৪৪ ধারা জারি করার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা লিখেছেন, ‘১৪৪ ধারা বলবৎ করার আদেশ দিতে গিয়ে মাননীয় বিচারক মন্তব্য করেন, পুলিশ কি পাওয়ারলেস? এই মন্তব্য অসাংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নাগরিক সুরক্ষার বিরোধী বলে মনে করি।’ ওই ব্যাপারে সরকারি হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়ে বিশিষ্টরা লিখেছেন, ‘অবিলম্বে সরকারকে আলোচনার মাধ্যমে এই জটিলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য আবেদন জানাচ্ছি। এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের যাতে না করা হয়, সে বিষয়ে দৃষ্টি দিতে অনুরোধ করছি।’
অন্য দিকে, অনশনরত চাকরিপ্রার্থীদের ‘শান্তিপূর্ণ’ আন্দোলনকে উৎখাত করার জন্য পুলিশি পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৃহবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রী, গবেষক, অধ্যাপক এবং শিক্ষাকর্মীরা। এরই পাশাপাশি সারা রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় শুক্রবার ওই ঘটনার প্রতিবাদে পথ অবরোধ-সহ বিবিধি আন্দোলন করেছেন বাম ছাত্র-যুবরা। বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের সঙ্গে পুলিশ-প্রশাসনের বচসা, ধস্তাধস্তি এবং সংঘর্ষও হয়েছে।
ওই ঘটনা নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-ও। তারা বলেছে, ‘শান্তিপূর্ণ ভাবে ধর্না-অনশনকারী ২০১৪-র টেট-উত্তীর্ণ প্রাথমিকের শিক্ষক-পদপ্রার্থীদের যে ভাবে বৃহস্পতিবার মাঝরাতে বলপ্রয়োগের মধ্যে দিয়ে পুলিশ তুলে নিয়ে গেল, তা চরম নিন্দনীয় তো বটেই, কোনও নির্বাচিত সরকারের পক্ষে চূড়ান্ত লজ্জার।’ তাদের আরও বক্তব্য, ‘হাইকোর্টের নির্দেশকে ঢাল করে প্রশাসন নিপীড়নের নতুন নজির তৈরি করল নৈশ অন্ধকারে। অথচ হাইকোর্ট ওই নির্দেশে কিন্তু চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের অধিকারের প্রশ্নে কোনও নিয়ন্ত্রণমূলক হস্তক্ষেপে রাজি হয়নি। তার পরেও এবং হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে ই-মেল করে আন্দোলনরত চাকরিপ্রার্থীরা জরুরি ভিত্তিতে তাঁদের বক্তব্য শোনার আর্জি জানানোর পরে যে পুলিশি অভিযান চালানো হল, তা এক ভাবে আদালত অবমাননারও সমতুল।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy