আরমানের অ্যাকাউন্টের লেনদেন খতিয়ে দেখে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, প্রথমে হৈমন্তীর অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা গিয়েছে ‘আরমান ট্রেডিং’ নামক একটি সংস্থার অ্যাকাউন্টে। প্রতীকী ছবি
চক্রাকারে হয়েছে টাকার লেনদেন! এক ব্যক্তির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে পাঠানো টাকা ঘুরেফিরে এমন একটি অ্যাকাউন্টে গিয়ে পৌঁছেছে, যার নমিনি সেই ব্যক্তি নিজেই! নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ধৃত তাপস মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত গোপাল দলপতি ওরফে আরমান গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নথি খতিয়ে দেখে সিবিআই এমন তথ্যই পেয়েছে বলে তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছে।
আরমানের অ্যাকাউন্টের লেনদেন খতিয়ে দেখে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, প্রথমে হৈমন্তী গঙ্গোপাধ্যায় নামের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা গিয়েছে ‘আরমান ট্রেডিং’ নামক একটি সংস্থার অ্যাকাউন্টে। তার পর ওই সংস্থার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা পৌঁছেছে আরমানের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে। ঘটনাচক্রে, একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে আরমানের সেই অ্যাকাউন্টের নমিনি আবার হৈমন্তী গঙ্গোপাধ্যায়! সিবিআইয়ের একটি সূত্রের দাবি, গোপালেরই আর এক নাম আরমান। দুই নামে তাঁর দু’টি প্যান কার্ডের হদিসও মিলেছে।
নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পরেই যুব তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষ প্রকাশ্যে আনেন গোপালের নাম। সেই কুন্তলের মুখেই বৃহস্পতিবার হৈমন্তীর নাম শোনা গিয়েছে। তার পর থেকেই এই ‘রহস্যময়ী’কে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। কুন্তল দাবি করেন, হৈমন্তী গোপালের স্ত্রী। গোপাল, অর্থাৎ আরমানের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নথিতেও ‘হৈমন্তী’ নামের হদিস পেলেন তদন্তকারীরা।
আরমানের অ্যাকাউন্টের কিছু নথি আনন্দবাজার অনলাইনের হাতে এসেছে। সেই নথির সত্যতা যদিও আনন্দবাজার অনলাইন যাচাই করেনি। তাতে দেখা গিয়েছে, হৈমন্তী নামের অ্যাকাউন্ট থেকে ‘ইমিডিয়েট পেমেন্ট সার্ভিস’ (আইএমপিএস) পরিষেবার মাধ্যমে যে টাকা পাঠানো হয়েছে, তা পরবর্তী কালে ‘হাত ঘুরে’ ঢুকেছে আরমানের অ্যাকাউন্টে। সাধারণত, দ্রুত টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে এই পরিষেবা ব্যবহার করা হয়। ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিং বা মোবাইল ব্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে ব্যবহার করা হয় এই পরিষেবা। ওই নথিতে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর হৈমন্তীর অ্যাকাউন্ট থেকে যে টাকা পাঠানো হয়েছে, তার আইএমপিএস নম্বর— ২৩৬....২৩৭ (তদন্তের স্বার্থেই সম্পূর্ণ নম্বর লেখা হল না)। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসেও ওই লেনদেন হয়েছে। গত ৫ জানুয়ারি হৈমন্তীর অ্যাকাউন্ট থেকে যে লেনদেন হয়েছে, তার আইএমপিএস নম্বর— ৩০০....৪২৩।
সিবিআইয়ের ওই সূত্রের মতে, দুর্নীতির ক্ষেত্রে এই ভাবে চক্রাকারে টাকা লেনদেনের প্রবণতা নতুন নয়। বিভিন্ন শেল কোম্পানির মাধ্যমে দুর্নীতির কালো টাকা সাদা করা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রেও সে রকম কিছু ঘটে থাকতে পারে। সেই কারণেই হৈমন্তীর অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরাসরি আরমানের অ্যাকাউন্টে না গিয়ে ‘আরমান ট্রেডিং’ নামক সংস্থার মাধ্যমে পৌঁছেছে বলেই ধারণা গোয়েন্দাদের।
‘আরমান ট্রেডিং’ সংস্থা সম্পর্কে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু তথ্য জোগাড় করেছে সিবিআই। গোয়েন্দাদের সূত্রে জানা গিয়েছে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নথি থেকে তাঁরা জানতে পেরেছেন, বড়বাজারে ওই সংস্থার অফিস রয়েছে। সংস্থাটির সঙ্গে যে আরমান ‘প্রত্যক্ষ’ ভাবে জড়িত, হাতে এসেছে সেই তথ্যপ্রমাণও।
সিবিআইয়ের ওই সূত্রটির দাবি, ঠিক কবে থেকে হৈমন্তী এবং আরমানের মধ্যে ভায়া ‘কোম্পানি’ টাকার লেনদেন শুরু হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সেই সূত্রে ২০১৭ সালের একটি লেনদেনও তদন্তকারীদের নজর কেড়েছে। ওই বছর মুম্বইয়ের একটি সংস্থার অ্যাকাউন্টে মোটা অঙ্কের টাকা পাঠানো হয়। তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই সংস্থার সঙ্গে হৈমন্তী এবং আরমানের কী সম্পর্ক, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বর্তমানে ওই সংস্থার সঙ্গে তাঁদের কোনও যোগাযোগ আছে কি না, জানার চেষ্টা চলছে তা-ও।
বৃহস্পতিবার জামিনের আর্জি খারিজ হওয়ার পর আলিপুর আদালত থেকে বেরোনোর সময় কুন্তল বলেন, ‘‘নিয়োগ দুর্নীতির টাকা হৈমন্তী গঙ্গোপাধ্যায়ের অ্যাকাউন্টে গিয়েছে।’’ তদন্তকারীদের ওই সূত্র জানাচ্ছে, কুন্তলের এই দাবি কতটা ঠিক বা আদৌ সঠিক কি না এবং হৈমন্তীর অ্যাকাউন্ট থেকে যে টাকার লেনদেন হয়েছে তা ‘নিয়োগ দুর্নীতি’র কি না, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
কুন্তল হৈমন্তীর নাম প্রকাশ করার পর থেকেই তাঁকে নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছে জনমানসে। তদন্তে উঠে এসেছে, হাওড়ার উত্তর বাকসাড়া এলাকায় হৈমন্তীর পৈতৃক বাড়ি। টালিগঞ্জেও তাঁর একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। পারিবারিক সূত্রে খবর, হৈমন্তী পেশায় মডেল। কুন্তলের অভিযোগের পর বৃহস্পতিবারই হৈমন্তীর সঙ্গে হোয়াটস্অ্যাপে যোগাযোগ করে আনন্দবাজার অনলাইন। জানতে চাওয়া হয়, তিনি গোপালের স্ত্রী কি না এবং গোপালের কোনও অ্যাকাউন্টে ‘নমিনি’ হিসাবে তাঁর নাম রয়েছে কি না। কিন্তু সেই মেসেজ দেখার পরেও কোনও প্রশ্নেরই জবাব দেননি হৈমন্তী। উল্টে কিছু ক্ষণ পর নিজের হোয়াটস্অ্যাপ ডিপি বদলে দেন।
অন্য দিকে সিবিআই সূত্রে খবর, অতীতে তদন্তকারীদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হলেও গত কয়েক দিন ধরে গোপালের সঙ্গে যোগাযোগও করা যাচ্ছে না। গোয়েন্দাদের একটি সূত্রের দাবি, তদন্তে নতুন যা যা তথ্য উঠে এসেছে, সেই ব্যাপারে গোপালকে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে নিয়োগে ‘দুর্নীতি’র জট আরও কিছুটা ছাড়ানো সম্ভব হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy