অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।
একচালার একটি বড় ঘর। বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা ‘আর্ত ও বিপন্ন রোগীদের পরিষেবায়’। ভিতরে গোটা চারেক চেয়ার। একটিতে গদি আঁটা। সামনে মাঝারি আকারের টেবিল। এক ধারে একটি সরু বেঞ্চ। দেওয়ালে জ্বলজ্বল করছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি। বেলা ১১টা নাগাদ ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে তিন জন। মাখার উপরে পাখা ঘুরছে। ঘাম মুছতে মুছতে এক জন বললেন, ‘‘এ বার এসি-টা লাগাতেই হবে।’’
প্রশাসনিক ভবনের উল্টো দিকের ওই ঘরটি কাগজে-কলমে তৃণমূল সমর্থিত প্রোগ্রেসিভ এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের অফিস। মঙ্গলবার সকালে রোগীর বাড়ির লোক পরিচয় দিয়ে ওই অফিসে পৌঁছে আইটিইউ-এ একটি শয্যা জোগাড়ের কথা বলতেই এক কর্মী জানালেন, ‘‘দাদারা নেই।’’ তাঁদের বলা হল, দাদাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেই এখানে আসা। কর্মীর প্রশ্ন, ‘‘আপনার রোগী কোথায় ভর্তি?’’ বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালের নাম বলতেই তাঁর নির্দেশ, ‘‘কাগজপত্র রেখে যান। কাজ হয়ে যাবে।’’ খরচ কত হবে জানতে চাওয়ায় সেই কর্মী বলেন, ‘‘আপনি কি কোনও রেফারেন্স নিয়ে এসেছেন? রেফারেন্স না থাকলে ১০ হাজার লাগবে।’’ এত টাকা কেন? উত্তর, ‘‘কত জায়গায় খরচ করে তবে তো বেড জোগাড় হয়!’’ প্রশ্ন করা হয়েছিল, টাকা খরচ করলে কাজটা হবে তো? তাঁর জবাব, ‘‘দাদারা আছেন কী করতে?’’
দর কষাকষি ১০ হাজার থেকে শুরু। সেটা কখনও কখনও দু’-এক হাজার কমেও যায়। সুপার স্পেশ্যালিটি এসএসকেএমে আইটিইউ-এর একটি শয্যা জোগাড় করতে যেখানে হন্যে হয়ে ছোটেন মুমূর্ষু বহু রোগীর পরিবার, সেখানে চোখের নিমেষে শয্যা জুটবে যদি ঠিক জায়গায় ‘ধরা’ যায়, আর কিছু ‘খরচাপাতি’র সামর্থ্য থাকে। আক্ষরিক অর্থেই ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’—এই বন্দোবস্ত চলছে রাজ্যের সেরা সরকারি হাসপাতালে। অভিযোগ, সর্ষের মধ্যে ভূতের প্রবাদকে সত্যি করে গোটা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন দুই ‘দাদা’ অর্থাৎ দুই জুনিয়র ডাক্তার।
শুধু তা-ই নয়, অভিযুক্ত ওই দুই জুনিয়র ডাক্তারই তৃণমূল সমর্থিত চিকিৎসক ইউনিয়নের নেতা। বাকি
যাঁরা থাকেন, বেশির ভাগই হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি সারদা-কাণ্ডে ধৃত মন্ত্রী মদন মিত্রের কেবিনে দিনের বেশির ভাগ সময়ই এঁদের কারও না কারও দেখা মেলে। ইউনিয়নের তরফে রাজেন ডোমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ নিয়ে কোনও কথা বলতে চাননি।
ওই অফিসে আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে যাওয়াই দস্তুর। তা না হলে সরাসরি অফিসে পৌঁছে ওঁদের সহকারীর কাছে কাগজপত্র ( কেস হিস্ট্রি) জমা দেওয়া যায়। হাসপাতাল সূত্রে খবর, বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে দীর্ঘ দিন ভর্তি থেকে প্রায় সর্বস্বান্ত হতে বসা রোগীর পরিজনেরা যেনতেন ভাবে সরকারি হাসপাতালে শয্যা চান। যেখানে বেসরকারিতে দিনে প্রায় ১০-১৫ হাজার টাকা খরচ, সেখানে সরকারি হাসপাতালে একটি বেড পাওয়ার জন্য এককালীন হাজার দশেক টাকা খরচ করে ফেলেন অনেকেই।
এসএসকেএম তথা ‘ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’-এর অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র স্বীকার করে নিয়েছেন, এমন অভিযোগ গত কয়েক মাস ধরে তাঁদের কাছেও আসছে। তাঁরা কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? তাঁর জবাব, ‘‘যাঁরা অভিযোগ করছেন, তাঁরা খুবই আতঙ্কিত। কোনও ভাবেই প্রকাশ্যে আসতে চাইছেন না। তাঁদের আশঙ্কা, তাঁরা অভিযোগ করছেন সেটা জানাজানি হলে বড় বিপদ হয়ে যাবে।’’
কিন্তু এটা এমনই একটা অভিযোগ যেখানে স্বাস্থ্য দফতর শুধু নয়, রাজ্য সরকারের সুনাম জড়িত। এমন ক্ষেত্রে তাঁরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? প্রদীপবাবুর যুক্তি, যে কোনও সরকারি প্রক্রিয়া শুরু করতে গেলে অভিযোগকারীর সশরীরে অস্তিত্ব থাকা দরকার। অভিযোগকারীরা আতঙ্কিত বলেই সমস্যা হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে। এ বার বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবতেই হবে।’’
এসএসকেএম সূত্রে খবর, অভিযুক্ত ওই দুই ডাক্তারের এক জন ওই হাসপাতালের হাউসস্টাফ। অন্য জন এক বছরের হাউসস্টাফশিপ শেষ করে বর্তমানে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে হাউসস্টাফ হিসেবে যোগ দিয়েছেন। যদিও হাসপাতালের ওয়ার্ডে এঁদের দেখা মেলে না বললেই চলে।
হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের সামনেই একটি অস্থায়ী অফিসঘর তৈরি করে হাসপাতালের অন্য কিছু কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে রোগী সহায়তার নানা কাজকর্ম চলে। সেই কাজের মধ্যেই রোগীকে শয্যা ‘পাইয়ে দেওয়া’র কাজও রয়েছে। শুধু আইটিইউ নয়, সাধারণ ওয়ার্ডের শয্যাও বহু সময়েই মেলে এঁদের হাত ধরে। সে ক্ষেত্রে ওয়ার্ডের ভিড়ের অবস্থা বুঝে ‘রেট’ ওঠানামা করে। যেমন, মেডিসিন, গাইনি বিভাগের ‘রেট’ কম। আবার সার্জারি, নেফ্রোলজি, কার্ডিওলজির রেট বেশি।
ইমার্জেন্সি বিভাগের ডাক্তারদের একটি বড় অংশই এঁদের বিরুদ্ধে বহু বার সরব হয়েছেন। কিন্তু কাজ হয়নি। ইমার্জেন্সির এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘আমাদের অবস্থা সবচেয়ে অসহায়। জেনে-বুঝে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছি।’’ তিনি বলেন, ‘‘কোনও গুরুতর রোগী এলেন, তাঁকে হয়তো তখন ভর্তি না করলেই নয়। কিন্তু ওয়ার্ডে খোঁজ নিয়ে জানলাম, বেড নেই। তাই ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হলাম। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে অন্য এক রোগী এলেন, যাঁর সমস্যা হয়তো খুবই সাধারণ। ভর্তি না করলেও চলে। চোখের পলকে সেই রোগীর বেড পাওয়া গেল। ডাক্তারেরাই যদি কোনও চক্রে জড়িয়ে থাকেন, তা হলে আর সেই চক্রের রমরমা বন্ধ করবে কে?’’
এসএসকেএমের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান, মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘এর আগে দালাল চক্র ভাঙতে পুলিশের সাহায্য নিয়েছিলাম। আবার পুলিশের সাহায্যই নিতে হবে। কিন্তু ডাক্তারদের মধ্যে কেউ যদি এর সঙ্গে জড়িত থাকেন, তা হলে তার চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে! তবে যে যা করছে, তার শাস্তি পেতেই হবে। খুব গুরুত্ব দিয়েই বিষয়টি দেখা হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy