বারুদ মাখা গায়েই কাজে ব্যস্ত। চম্পাহাটিতে। নিজস্ব চিত্র
পেটের টান জীবনের ঝুঁকি থেকেও বড়। তাই ঝুঁকির কথা জেনেও শিশু-কিশোরদের বাজি কারখানার কাজে ঢুকিয়ে দেন বাবা-মায়েরা। অদক্ষ নাবালক হাতও আতসবাজি থেকে শব্দবাজি, কিছু তৈরিতে পিছপা নয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার চম্পাহাটি-নুঙ্গির বাজির আঁতুড়ঘরে এমনই কথা ঘোরে মুখে মুখে।
এলাকায় গিয়ে শোনা যায়, এখানে নাবালকদের কাছে বাজি তৈরি কার্যত ‘জল ভাত’। উৎসবের মরসুমে যখন শ্রমিকের চাহিদা সবচেয়ে বেশি, তখন এই কাজে অনায়াসে হাত লাগায় বছর ১৫ থেকে ১৭-র ছেলেরা। যদিও প্রশিক্ষণ নেই বেশির ভাগেরই।
বাবা-কাকাদের বাজি তৈরি করতে দেখেই শেখা।
চম্পাহাটির বেগমপুর, হারাল, সোলগলিয়া হোক বা মহেশতলার নুঙ্গি, পুটখালি, বলরামপুর— এক কথায়, শব্দবাজির আঁতুড়ঘর বলেই বছর বছর ধরে পরিচিত এই এলাকা। কিন্তু শব্দবাজিতে কড়াকড়ি বাড়ায় ওই সব এলাকার নানা কারখানায় আতসবাজিও তৈরি হয়। এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘চকলেট বোমার থেকে আতসবাজি তৈরিতেই বেশি ঝুঁকি। নানা রাসায়নিক মিশিয়ে ওই সব বাজি তৈরি করতে হয়। নাইট্রোগ্লিসারিনের মতো অতিদাহ্য রায়াসনিকও ব্যবহার হয়।’’ সম্প্রতি সোনারপুরের গোবিন্দপুরে একটি কারখানায় ‘শেল’ তৈরির সময়ে পরপর বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল এলাকা। মৃত্যু হয় দুই নাবালকের। জখম হয়েছিলেন প্রায় ১২ জন শ্রমিক। এলাকায় গিয়ে শোনা যায়, পুজোর সময়ে পরিবারে বাড়তি টাকা আনতেই আতসবাজি তৈরিতে হাত লাগিয়েছিল কয়েক জন নাবালক। অতিদাহ্য রাসায়নিক মেশানোর সময়ে বিস্ফোরণ ঘটে বলে জানাচ্ছে ফরেন্সিকের রিপোর্টে। এর পরে পুলিশি নজরদারি প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। তবু থামেনি নাবালকের হাতে বাজি তৈরি। চম্পাহাটির চিনের মোড়ের এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘পেটের দায় বাবা-মায়ের হাত ধরেই কারখানায় আসে ওরা। আপনি চাইলেও আটকাতে পারবেন না।’’
বাজি কারখানায় সাত-আট বছরের ছেলে-মেয়েকেও কাজ করতে দেখা যায়। তবে স্থানীয়েরা জানান, ওরা বাজি তৈরিতে নেই। কেউ ফুলঝুরি শুকিয়ে প্যাকেটে ভরে, কেউ সুতলি বাঁধা কিংবা বোমার গায়ে রাংতা মোড়ানোর কাজ করে। তবে বিপজ্জনক দ্রব্যে ভরা কারখানাতেই থাকে ওরা। আতসবাজি তৈরির সময়ে বিস্ফোরণ ঘটলে, ওদেরও জখম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানালেন এক কারখানা মালিক।
ঝিরঝিরে বৃষ্টির দুপুরে সরু গলি দিয়ে কিছুটা হেঁটে বাঁশ ঝাড় পেরিয়ে হাজির হওয়া গিয়েছিল দরমা ও টিনে ঘেরা আর একটি কারখানায়। দেখা গেল, সারা গায়ে বারুদ মাখা এক দল শিশু বাজি তৈরিতে ব্যস্ত। আগন্তুককে দেখে এক শিশু বলে, ‘‘বাবু বাড়িতে আছে। আপনার কি অর্ডার রয়েছে? তবে বাবুর ঘরে যান।’’ পথ চেনাতে বেরোল সে-ই। কথায় কথায় জানাল, ‘‘আমরা তিন ভাই-বোন। বাবা ভ্যান চালান। জিনিসের খুব দাম। তাই আমি আর দিদি বাজি তৈরি করি। ছোট ভাই পড়াশোনা করে।’’ গল্পে গল্পে পৌঁছনো গেল মালিকের বাড়ি। শিশু শ্রমিকদের প্রসঙ্গ উঠতে মালিক বলেন, ‘‘এ তো একটা কারখানার ব্যাপার নয়, গোটা এলাকাই বাজি তৈরিতে যুক্ত। মহিলা থেকে শিশু, পেটের দায়ে সকলে বাজি বানান। ঠেকাবেন কী ভাবে?’’ তিনিই জানান, চিন্তা শুধু দুর্ঘটনা নিয়ে নয়, বারুদ থেকে নানা চর্মরোগও হতে পারে। রোগ যাতে না হয়, সে দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয় বলে তাঁর দাবি। তিনি বলেন, ‘‘ওরা কাজের পরে স্নান করে। আমরা দৈনিক মজুরির সঙ্গে ওদের চর্মরোগের ওষুধও দিয়ে থাকি। যাতে চামড়ার যত্নটা নিয়মিত হয়।’’ মালিকের দাবি, সারা দিন কাজ করলে নগদ তিনশো টাকা পায় ওরা। এরই সঙ্গে বেশির ভাগ সময়ে চামড়ার রোগের ওষুধ দিয়ে দেওয়া হয়। মালিকের বক্তব্য, ওষুধ কেনার টাকা দিলে অনেকেই তা কেনে না। কিন্তু বারুদ থেকে চামড়ার রোগ হওয়ার ঝুঁকিটা এতই বেশি যে কোনও গাফিলতি চলে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy