জলকন্যা। তাহরিনা নাসরিনের ছবি তুলেছেন সুব্রত জানা।
ইংলিশ চ্যানেল পার করার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন যিনি, তাঁর জীবনে দাঁড়ি পড়ে গিয়েছে কয়েক মাস আগেই। গুরুর এই প্রয়াণই জেদ বাড়িয়েছিল সাঁতারু তাহরিনার। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ইংলিশ চ্যানেল পার করেই গুরুকে শ্রদ্ধা জানাবেন। হাওড়ার উলুবেড়িয়ার মেয়ে বছর একুশের তাহরিনা নাসরিন কথা রেখেছেন। গত ৩ সেপ্টেম্বর সফল ভাবে ইংলিশ চ্যানেল পার করেছেন তিনি। দিন কয়েক আগে ফিরেছেন নিজের বাড়িতে।
উলুবেড়িয়ার নিমদিঘিতে তাহরিনাদের বাড়ির সামনেই রয়েছে দু’টি বড়ো পুকুর। দু’বছর বয়সে সেখানেই সাঁতার শিক্ষায় হাতেখড়ি তাঁর। পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর সাঁতার শিখতে উলুবেড়িয়া পুরসভার সুইমিং পুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে উলুবেড়িয়ারই একটি সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অনুশীলন শুরু করেন তিনি। ইংলিশ চ্যানেল জয়ী মেয়ের বাবা শেখ আফসার আহমেদের কথায়, ‘‘আমাদের পরিবারে দু’-তিন বছর বয়স হলেই বাড়ির পাশের পুকুরে সাঁতার শেখানো হয়। তাহরিনার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।’’ তিনি জানান, ২০০৫ সাল থেকেই সাঁতারের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ভাল ফল করতে শুরু করে তাঁর মেয়ে। ২০০৯ সালে মাসুদুর রহমানের সঙ্গে আলাপ তাঁরা। কিন্ত তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায় ২০১৩ সালে। সে বছরই বেলেঘাটা সুভাষ সরোবরে মাসুদুর রহমানের কাছে সাঁতারের অনুশীলন শুরু করেন তাহরিনা। তার আগে ২০১২ সালে তিনি ইনকাম ট্যাক্সের চাকরি পেয়ে গিয়েছেন। তাহরিনার কথায়, ‘‘২০০৯ সালেই স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করেন তুই ইংলিশ চ্যানেল পেরোতে পারবি? আমি বলেছিলাম, পারব। ২০১৩ সালে সেই লক্ষ্যেই অনুশীলন শুরু করি।’’ ২০১৩ থেকে শুরু করে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সকাল ৯টায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে অফিস করে তার পর বেলেঘাটায় সাঁতার শিখতে যেতেন তিনি।
গত ২৬ এপ্রিল মারা যান মাসুদুর রহমান। সেই সময় ইংলিশ চ্যানেল পার করার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন তাহরিনা। তখন বাবা এগিয়ে আসেন মেয়েকে সাহস জোগাতে। কলকাতা ময়দানের কুমোরটুলি দলের প্রাক্তন ফুটবলার শেখ আফসার আহমেদ মেয়েকে বোঝান, ইংলিশ চ্যানেল সফল ভাবে পেরোতে পারলে তবেই মাসুদুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে। সব ঠিক হয়ে যাওয়ার পরও কলকাতার ব্রিটিশ হাই কমিশন তাঁর ভিসার আবেদন বাতিল করে দিয়েছিল একেবারে শেষ মুহূর্তে। সব আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন তিনি। তবে শেষমেশ কয়েকজন হিতৈষী আর কিছু সিনিয়র অলিম্পিয়ানের সাহায্যে ইংলিশ চ্যানেল পেরোনোর অনুমতি পান। কিন্তু, খরচ বেড়ে দাঁড়ায় তিনগুণ। বাকিটা তো ইতিহাস।
তাহরিনা জানান, ৩ সেপ্টেম্বর ভোর ৩টে ২৫ মিনিটে ইংলিশ চ্যানেলের জলে নামেন তিনি। চ্যানেল পার করেন বিকেল ৪টে ৩ মিনিট। তিনি বলেন, ‘‘জলে প্রবল ঢেউ ছিল। গায়ে জেলিফিশ জড়িয়ে যাচ্ছিল। সাঁতার শেষ করার পরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তবে শেষ পর্যন্ত মানসিক জোর হারাইনি।’’
ইংলিশ চ্যানেল জয় করা ছাড়াও রাজ্য ও জাতীয় স্তরের সাঁতারে ভাল ফল করেছে তাহরিনা। ইন্দো-বাংলা গেমস, ন্যাশানাল উইমেন্স গেমসে দলগত ভাবে রিলে রেসে পদক রয়েছে তাঁর। স্বপ্ন সফল হওয়ার পরে এখন তাঁর লক্ষ্য দেশের হয়ে পদক জেতা। তাঁর কথায়, ‘‘মাসুদুর স্যার বলতেন, যদি তোমার সাফল্য দেশকে গর্বিত করতে পারে তবেই তুমি সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন। আমি ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়েছি। আমি চাই, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আরও অনেক মেয়ে এই চ্যানেল পার করুক।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy