দু’দিকে পর্ষদের দু’টি ওয়েবসাইটের রবিবার রাতে নেওয়া স্ক্রিনশট। বাঁ দিকেরটিতে ছিল রহস্যময় সেই লিঙ্ক।
আনন্দবাজার অনলাইন পারেনি। ফেলুদা কি পারতেন? বা ব্যোমকেশ বক্সী? কিম্বা কিরীটি রায়?
রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি নিয়ে সিবিআই এবং ইডি যখন তদন্তে ব্যস্ত, ঠিক তখনই ২০১৭-র টেটের ফলাফল নিয়ে রহস্যময় ব্যাপার ঘটল রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের ওয়েবসাইটে। রবিবার পর্ষদের একটি ওয়েবসাইটে ২০১৭ সালের টেট (প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা)-এর ফলাফল জানার একটি ‘লিঙ্ক’ আচমকাই ভেসে ওঠে। আবার রাত কাটতে না কাটতেই সোমবার সকালে ‘লিঙ্কটি’ উধাও হয়ে যায়! রহস্য উন্মোচনে সোমবার থেকে নানা ভাবে পর্ষদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে আনন্দবাজার অনলাইন। যোগাযোগের চেষ্টা হয় রাজ্য শিক্ষা দফতরের সঙ্গেও। বুধবার দুপুরে বার্তা পাঠানো হয় শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকেও। কিন্তু বিকেল পর্যন্ত কারও তরফে কোনও উত্তর মেলেনি। তার পর বুধবার বিকেলে আচমকাই পর্ষদের সচিব রত্না বাগচীর তরফ থেকে বিষয়টি জানতে চেয়ে আনন্দবাজার অনলাইনকে বার্তা পাঠানো হয়। তাঁকে আবার বিষয়টি জানানো হয়। তার কিছু ক্ষণের মধ্যে পর্ষদের সাইটে দেওয়া হয় একটি নোটিস। তাতে লেখা, ২০১৭ সালের টেটের ফলাফল সম্পর্কিত ‘কোনও নোটিস সাম্প্রতিক কালে দেওয়া হয়নি’। উন্মোচন হওয়া দূরস্থান, এর ফলে রহস্য আরও ঘনীভূত। তা হলে পর্ষদের ওয়েবসাইটে কে বা কারা ওই লিঙ্ক আপলোড করল? বুধবার রাত পর্যন্ত তার উত্তর মেলেনি।
ওয়েবসাইট হ্যাকিং বা অন্য কোনও অভিযোগ জানিয়ে পর্ষদের পক্ষ থেকে পুলিশে যাওয়া হয়েছিল কি না, তারও খোঁজ নিয়েছিল আনন্দবাজার অনলাইন। বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের এক শীর্ষকর্তা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোনও অভিযোগ তাঁদের কাছে দায়ের হয়নি।
২০১৭ সালে বিজ্ঞপ্তি জারি করা টেট-এর লিখিত পরীক্ষা হয় ২০২১ সালের জানুয়ারিতে। ফলাফলের বিজ্ঞপ্তি জারি হয় এ বছর অর্থাৎ ২০২২-এর ১০ জানুয়ারি। পর্ষদ সচিব সাক্ষরিত সেই বিজ্ঞপ্তিতে (নম্বর. ৩৯/বিপিই /২০২২) জানানো হয়, দুটি ওয়েবসাইটে ২০১৭-র টেটের ফলাফল জানা যাবে। দুটি ওয়েবসাইটের লিঙ্কও দেওয়া হয়েছিল ওই বিজ্ঞপ্তিতে (www.wbbpe.org এবং www.wbbprimaryeducation.org)। সাধারণ ভাবে একটি সংস্থার একটি ওয়েবসাইট থাকে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের দু’টি ওয়েবসাইট রয়েছে।
সূত্রের খবর, ১০ জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দু’টি ওয়েবসাইটেই ফলাফল দেখার সুযোগ ছিল। কিন্তু তার ছ’মাস পর, গত রবিবার রাতে হঠাৎ ওই দু’টি ওয়েবসাইটের একটিতে (www.wbbprimaryeducation.org) কেন পরীক্ষার ফলাফল দেখার ‘লিঙ্ক’টি আবার দেখা গেল, তা নিয়েই দানা বেঁধেছে রহস্য। একই সঙ্গে সোমবার সকালে ওই ওয়েবসাইট থেকে নির্দিষ্ট ‘লিঙ্ক’টি কেনই বা উধাও হয়ে গেল তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
কী ছিল রহস্যজনক ওই ‘লিঙ্কে’
গত বেশ কয়েক দিন ধরে সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটটি (www.wbbprimaryeducation.org) খুললে দেখা যাচ্ছিল হোমপেজে ২০১৪-র টেট উত্তীর্ণ এবং প্রশিক্ষিত প্রার্থীদের শংসাপত্র এবং ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের ডি.ইআই.ইডি পার্ট-টু-র ফলাফলের দুটি লিঙ্ক রয়েছে। রবিবার রাতে এই দুটি লিঙ্কের মাঝেই ‘রেজাল্ট অফ টেট-২০১৭-এক্সামিনেশন, কনডাক্টেড বাই ডব্লিউবিবিপিই’ লেখা আরও একটি লিঙ্ক চলে আসে। লিঙ্কটির শেষে লাল রঙে ‘নিউ’ লেখা মার্কার দেওয়া ছিল। নতুন কোনও বিষয় ওয়েবসাইটে আনা হলে এই ধরনের ‘নিউ’ লিখে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়ে থাকে। ওই লিঙ্কে ক্লিক করার পর আর একটি ওয়েবসাইট পেজ (www.wbprim-tet.in) খুলে যায়। যে পাতায় লেখা ছিল— প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির জন্য টেট ২০১৭-র ফল [রেজাল্ট অব টিচার এলিজিবিলিটি টেস্ট (টেট) ২০১৭ (ফর ক্লাস ওয়ান-ফাইভ)]। পাতাটিতে রোল নম্বর এবং জন্ম তারিখ লেখার জায়গা ছিল। ছিল ‘সাবমিট’ এবং ‘রিসেট’ অপশন দুটিও। এক পরীক্ষার্থীর রোল নম্বর এবং জন্ম তারিখ দিয়ে ফলাফল দেখার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে বলা হয়, ‘সঠিক রোল এবং জন্ম তারিখ দিন’।
এই ‘লিঙ্ক’ সম্পর্কে জানতে আনন্দবাজার অনলাইনের পক্ষ থেকে সোমবার দুপুরে পর্ষদের সচিব রত্না বাগচী এবং রাজ্যের শিক্ষা সচিব মণীশ জৈনের সঙ্গে তাঁদের দফতরে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দু’জনের কারও সঙ্গেই দেখা করার অনুমতি মেলেনি। ওই দিনই সন্ধ্যায় পুরো ঘটনাটি বিস্তারিত জানিয়ে রত্না এবং মণীশকে হোয়াটস্অ্যাপ করা হয়। রত্নার তরফ থেকে কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে সোমবার রাতেই একটি ল্যান্ড লাইন নম্বর থেকে ফোন করে বলা হয়, শিক্ষা সচিবকে করা হোয়াটস্অ্যাপ মেসেজের পরিপ্রেক্ষিতে ওঁর দফতর থেকে ফোনটি করা হয়েছে। নাম জানাতে অনিচ্ছুক ওই ব্যাক্তি বলেন, “পর্ষদ যেহেতু স্বয়ংশাসিত সংস্থা, তাই ওদের দৈনন্দিন বিষয়ে আমরা খুব একটা নাক গলাই না।”
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পর্ষদের সচিব বা সভাপতির সঙ্গে কথা বলার পরামর্শও দেওয়া হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল— নিয়োগ সংক্রান্ত যে বিষয়টি বিচারাধীন, একযোগে সিবিআই এবং ইডি যার তদন্ত করছে, যে মামলায় ইডির হাতে গ্রেফতার হয়েছেন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় স্বয়ং, সর্বোপরি যে ফলাফলের উপর লক্ষাধিক পরীক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে আছে— সেই বিষয়টিকে ‘দৈনন্দিন’ সাধারণ বিষয়ের পর্যায়ে ফেলা যায় কি!
নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে নেমে দুই কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা একের পর এক শিক্ষাকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করছে। কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি পদ থেকে অপসারিত হয়েছেন মানিক ভট্টাচার্য। সিবিআইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে পর্ষদের সচিব রত্নাকেও। এই পরিস্থিতিতে সেই পর্ষদের ওয়েবসাইটেই ফলাফলের রহস্যময় লিঙ্কটি কী ভাবে উঠল এবং কয়েক ঘণ্টা থেকে গেল, এবং তা নিয়ে শিক্ষাকর্তারা কেন মুখে কুলুপ আঁটলেন, সে রহস্য বুঝতে মঙ্গলবার আবার মণীশ এবং রত্নার দফতরে যায় আনন্দবাজার অনলাইন। সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ওয়েবসাইটের ওই নির্দিষ্ট সময়ের স্ক্রিন শট। পর্যদের দফতরে রত্নার সঙ্গে দেখা হলেও, তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে অস্বীকার করেন। পর্ষদকর্তাদের অনুমতিতেই ওই লিঙ্ক ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছিল কি না, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনও উত্তর দেননি রত্না। এর পর বিকাশ ভবনে গিয়ে মণীশের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চাওয়া হয়। কিন্তু সেই অনুমতি মেলেনি।
বুধবার দুপুরে এ বিষয়ে কথা বলতে চেয়ে আনন্দবাজার অনলাইন যোগাযোগ করে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গে। ব্রাত্যের তরফ থেকে কোনও উত্তর না মিললেও, তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রত্না একটি বার্তা পাঠান হোয়াট্সঅ্যাপে। তথ্যপ্রমাণ চেয়ে পাঠান। উত্তরে তাঁর মেল আইডি চাওয়ার পাশাপাশি কিছু প্রশ্নও পাঠায় আনন্দবাজার অনলাইন। প্রশ্ন ছিল, রবিবার রাতের ঘটনা পর্ষদ জানে কি না এবং পর্ষদের সিদ্ধান্তেই লিঙ্কটি আপলোড করা হয়েছি কি না। উত্তর না পেয়ে ফোন করা হয় রত্নাকে। একই প্রশ্ন রাখা হয় ফোনেও। রত্না বলেন, “দেখতে হবে। হ্যাক হয়েও থাকতে পারে।” ফোনটি মাঝপথে কেটে যায়। পরে আবার রত্নাকে ফোন করা হলে এক পুরুষকণ্ঠে জানানো হয়— রত্না মিটিংয়ে আছেন, এবং তাঁদের ওয়েবসাইটে এই সংক্রান্ত একটি নোটিস দেওয়া হয়েছে।
নোটিসটি খুলে দেখা হয়। তাতে লেখা, ‘টেট-২০১৭-র ফল ১০.০১.২০২২ প্রকাশিত হয়েছিল পর্ষদের নিম্নলিখিত ওয়েবসাইটগুলিতে।’ এর পর দুটি ওয়েবসাইটের অ্যাড্রেস দেওয়া হয়। তার পর লেখা হয়, ‘সম্প্রতি, পর্ষদ এই সংক্রান্ত কোনও নোটিস প্রকাশ করেনি। এটি সংস্লিষ্ট সকলের অবগতির জন্য।’ নীচে পর্ষদ সচিব রত্নার স্বাক্ষর।
এই নোটিসের পর রহস্য আরও ঘনীভূত। তা হলে রবিবার রাতে ওই লিঙ্ক (যার স্ক্রিনশট এবং স্ক্রিন রেকর্ড আনন্দবাজার অনলাইন করেছে) কী ভাবে পর্ষদের সাইটে ভেসে উঠল? কারা করল? সচিবের সন্দেহ মতো তবে কি কেউ হ্যাক করেছিল ওয়েবসাইট? হলে পর্ষদের তরফ থেকে কি বুধবার দুপুরের পর পুলিশে কোনও অভিযোগ দায়ের হয়েছে বা হবে? কোনও প্রশ্নেরই উত্তর মেলেনি এখনও।
২০১৭-র টেট দিয়ে চাকরিপ্রার্থীদের একজন সুপর্ণা চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘জানুয়ারি মাসে আমাদের ফলাফল প্রকাশ হয়। ফেব্রুয়ারির পর ওয়েবসাইটে ফলাফল দেখার লিঙ্কটি আর দেখা যায়নি। এতদিন পর ফলাফলের ভুতুড়ে লিঙ্ক এল কোথা থেকে? কাদের ফলাফল এই লিঙ্কের মাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছে সেটাই আশ্চর্যের বিষয়।’’ ২০১৭-র টেটে ৯,৮০০-র বেশি পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন বলে জানানো হয়েছিল। সুপর্ণার দাবি, যাঁরা ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, পিডিএফে তাঁদের তালিকা প্রকাশ করা হোক।
শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে মামলা লড়ছেন আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। বিষয়টি শুনে তিনি বলেন, ‘‘স্কুল শিক্ষা পর্ষদ বা শিক্ষা দফতর কেউ নিজেদের সততার সঙ্গে কোনও রেকর্ড রাখছেন না। এবং এরা ডিজিটাল রেকর্ডকেও ম্যানিপুলেট করার চেষ্টা করছেন। পর্ষদ যদি এই লিঙ্ক সম্পর্কে কিছু না জানে, তা হলে তদন্ত হওয়া উচিত।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy