স্কুল শিক্ষক তরুণ মজুমদার। —নিজস্ব চিত্র।
এক সময়ের রুখা সুখা কদমডাঙা এখন ছায়ায় ঘেরা। সেখানে শেষ জ্যৈষ্ঠের বাতাস ভারী হয়ে আছে আমের সুঘ্রানে।
যাঁর হাতের স্পর্শে রাতারাতি বদলে গিয়েছে গোটা প্রকৃতি, তিনি কদমডাঙা প্রাথমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষক তরুণ মজুমদার। বছর বারো আগে তাঁরই হাতে বসানো আম গাছের চারাগুলি ডালপালা মেলেছে এখন। ফল দিচ্ছে। আমের স্বাদে যে শুধু দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমন্ডি ব্লকের তাঁতিপুকুর তৃপ্ত হচ্ছেন তাই নয়, আম বিক্রির টাকায় ধীরে ধীরে কদমডাঙা প্রাথমিক স্কুলকেও সাজিয়ে তুলছেন তরুণবাবু।
তাঁতিপুকুর থেকে কদমডাঙা প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত প্রায় দু’কিলোমিটার রাস্তার দু’ধার জুড়ে আম গাছ লাগিয়েছিলেন তিনি। তখন বিশেষ কেউ পাশে না থাকলেও গাছ-পাগল স্যারের উদ্যোগে এখন সামিল গোটা এলাকার মানুষ। বাসিন্দাদের প্রত্যেকেই বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন পাঁচশোর বেশি আম ও জাম গাছের ওই ‘বাগানকে’। তাই ফলে পাক ধরলে প্রতি বছর স্বপ্ন ছোঁয়ার আনন্দে মাতেন স্থানীয় মানুষজন। তরুণবাবুর কথায়, ‘‘স্কুলের শিশুরা সকলেই গরিব ঘরের। এই খুদেদের কথা ভেবে আর সুখা এলাকাটাকে একটু ছায়া দিতে আম গাছ লাগানোর কথাই প্রথম
মনে এসেছিল।’’
হিলির তিওড় এলাকার বাসিন্দা তরুণবাবু কদমডাঙা প্রাথমিক স্কুলে বদলি হয়ে এসেছিলেন ২০০০ সালে। চার বছর পর থেকে নিজের বেতনের টাকাতেই এলাকার নার্সারি থেকে আম গাছের চারা কিনে রাস্তার দু’ধারে পুঁততে শুরু করেছিলেন। নিজের উদ্যোগেই স্থানীয় কয়েকজন শ্রমিককে নিযুক্ত করেছিলেন গাছগুলোর পরিচর্যার জন্য।
কদমডাঙা স্কুলের প্রধান শিক্ষক লুতফর রহমান বলেন, ‘‘পঞ্চায়েতের উদ্যোগে একবার আকাশমনি, ইউক্যালিপ্টাস, কদম গাছ লাগানো হয়েছিল। কিন্তু বাঁচানো যায়নি। তাই তরুণবাবুর এই গাছ লাগানো দেখে অনেকেই বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। কয়েক বছর যেতেই অবশ্য মাথা তুলে দাঁড়িয়ে যায় ৫০৪টি বিভিন্ন প্রজাতির আমগাছ ও ২৫টি জামগাছ।’’
এলাকার বাসিন্দা মজিদ মিঁঞা, নজরুল মণ্ডলরা জানান, এত আম খেয়ে শেষ করা যায় না। গত দু’বছর ধরে গাছের আম বিক্রি করার ব্যবস্থা করেছেন ওই শিক্ষক। সেই টাকায় প্রাথমিক স্কুলে পানীয় জলের ব্যবস্থা করেছেন। রঙিন টিভি ও ভিডিও কিনে খুদে পড়ুয়াদের পঠনপাঠনে আকর্ষণ বাড়িয়েছেন। প্রথম বছর আম বিক্রির টাকায় স্কুলের পড়ুয়াদের জামা প্যান্ট কিনে দিয়েছেন। বসার বেঞ্চ থেকে পঠনপাঠনের আনুসঙ্গিক জিনিসপত্র এসেছে আম বিক্রির টাকা থেকে।
তরুণবাবু বলেন, ‘‘এ বছর মালদহ থেকে বিক্রেতারা ২৫ হাজার টাকায় গাছের আম কিনে নিতে চেয়েছিলেন। বাসিন্দারা ১২ হাজার টাকা দিতে চান। আমি স্থানীয়দেরই অগ্রাধিকার দিয়েছি। ওরাই তো রাতবিরেতে গাছগুলিকে রক্ষা করেন।’’
মহিপাল এলাকায় টিনের চালের ভাড়া বাড়িতে স্ত্রী অর্চনাদেবীকে নিয়ে থাকেন নিঃসন্তান তরুণবাবু। অর্চনাদেবীর কথায়, ‘‘স্কুল আর গাছ নিয়ে সর্বক্ষণ উনি মেতে থাকেন। খাওয়া-দাওয়ারও কোনও ঠিক নেই।’’ এখন গরমের ছুটি স্কুলে। তাতে কী? সকালে উঠেই তরুণবাবু পাঁচ কিলোমিটার দূরে কদমডাঙায় ছোটেন। গাছের দেখাশোনা করেন। এলাকার গ্রামগুলিতে ঘুরে পড়ুয়াদের খোঁজ নিয়ে তবেই বাড়ি ফেরা।
চার বছর পরেই স্কুলের চাকরি থেকে অবসর নেবেন তরুণবাবু। তবে গাছ আর পড়ুয়াদের নিয়ে তাঁর এই জীবন ভাবনায় যে বদল আসবে না, তা জানাতে ভোলেননি কদমডাঙার গাছ পাগল মাস্টার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy