সুজয়কৃষ্ণ জানতেন, তিনি ভোটে হারবেন। তা-ও কেন দাঁড়ালেন? তা-ও আবার একেবারে মমতার বিরুদ্ধে? ফাইল চিত্র ।
নিয়োগ দুর্নীতির ‘প্যাঁচ’ খুলতেই একে একে উঠে আসছে নতুন নতুন নাম। তার মধ্যে অন্যতম ‘কালীঘাটের কাকু’ ওরফে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র। নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে একাধিক অভিযুক্তের মুখে তাঁর নাম উঠে আসার পর থেকেই সুজয়কে নিয়ে কৌতূহল বেড়েছে। তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় নিয়েও উঠেছে একাধিক প্রশ্ন। সেই আবহেই জানা গেল, বেহালার বাসিন্দা সুজয় প্রার্থী হয়েছিলেন বিধানসভা ভোটে। স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে!
অধুনা ‘কালীঘাটের কাকু’ পরিচয়ে পরিচিত সুজয়কৃষ্ণ প্রার্থী হয়েছিলেন ভবানীপুর কেন্দ্রের উপনির্বাচনে। যে কেন্দ্রের প্রার্থী হয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। প্রত্যাশিত ভাবেই সেই ভোটে জেতা তো দূরস্থান, দাগও কাটতে পারেননি সুজয়। ধীরে ধীরে রাজনীতির আঙিনা থেকেও তিনি হারিয়ে যান। অধুনা সুজয়কৃষ্ণের দাবি, তিনি আর ‘সক্রিয়’ রাজনীতিতে নেই।
সুজয়কৃষ্ণ জানতেন, তিনি ভোটে হারবেন। তা-ও কেন দাঁড়ালেন? তা-ও আবার একেবারে মমতার বিরুদ্ধে?
‘কালীঘাটের কাকু’র জবাব, ‘‘আমি মমতার বিরুদ্ধে দাঁড়াইনি। ভোটে দাঁড়ানোর ইচ্ছে হয়েছিল। আমার বাড়ি বেহালায়। ব্যালটপেপারে এমন একজনের সঙ্গে নামটা থাকলে ভাল লাগে। রাম-শ্যাম-যদু-মধুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লাভ কী! তা ছাড়া আমায় কে চেনে যে, ভোট দেবে! বুথে বুথে ঘুরতে পারব, এটাই আমার ইন্টারেস্ট।’’
২০১১ সাল। রাজ্যে তখন মমতাঝড়। তাঁর নেতৃত্বেই সাড়ে ৩৪ বছরের মসনদ হাতছাড়া হয়েছে বামেদের। ক্ষমতায় ‘পরিবর্তনের সরকার’। মুখ্যমন্ত্রী মমতা। কিন্তু তিনি তখনও রাজ্যের বিধায়ক নন। তাই উপনির্বাচনে দাঁড়িয়েলেন ভবানীপুর থেকে। সেই ভোটেই ভবানীপুর কেন্দ্রে মমতার বিরুদ্ধে নির্দল প্রার্থী হিসাবে দাঁড়িয়েছিলেন সুজয়কৃষ্ণ।
অনেকের মতে, তিনি দাঁড়িয়েছিলেন তৃণমূলের ‘ডামি’ প্রার্থী হিসাবে। বিভিন্ন ভোটে এই ‘ডামি’ প্রার্থী দাঁড় করানোর রীতি প্রাচীন। এর লক্ষ্য, ভোটগণনার সময়ে গণনাকেন্দ্রে কাউন্টিং এজেন্ট বাড়িয়ে নেওয়া। প্রার্থী প্রতি দু’জন করে কাউন্টিং এজেন্ট থাকেন। মূলস্রোতের কোনও প্রার্থীর সঙ্গে যদি একাধিক ‘ডামি’ প্রার্থী থাকেন, তা হলে তাঁরাও নিয়ম অনুযায়ী দু’জন করে কাউন্টিং এজেন্ট পান। ফলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর এজেন্টরা দলে ভারী হন। যুগ যুগ ধরে এই ‘ফিকির’ চলে আসছে। তৃণমূলের অন্দরের বক্তব্য, সুজয়কৃষ্ণকেও সেই কারণেই ‘ডামি’ নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছিল। তিনি নিজে অবশ্য দাবি করেছেন, ‘‘আমাকে অনেকে বলেছিলেন, কেন আমি ভোটে দাঁড়াতে গেলাম! তবে আমি কারও কথায় ভোটে দাঁড়াইনি।’’ অর্থাৎ, তিনি নিজেকে ‘ডামি’ প্রার্থী বলে মানতে চাননি। চান না।
সেই উপনির্বাচনে ওই কেন্দ্রে সিপিএমের প্রার্থী ছিলেন নন্দিনী মুখোপাধ্যায়। বলা বাহুল্য, তিনি হেরে গিয়েছিলেন। মোট ৭৩,৬৩৫ ভোট পেয়ে জিতেছিলেন তৃণমূলনেত্রী মমতা। সিপিএম প্রার্থী নন্দিনী-সহ বাকি সকল প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট মমতার ধারেকাছেও ছিল না। ‘নির্দল’ সুজয়কৃষ্ণ পেয়েছিলেন মাত্র ৮০৯টি ভোট।
মমতার জয়ের ব্যবধান এতটাই ছিল যে, গণনাকেন্দ্রে তাঁর ‘ডামি’ প্রার্থীর বাড়তি এজেন্ট বসানোর প্রয়োজন হয়নি। বস্তুত সেই উপনির্বাচনে সুজয়কৃষ্ণ-সহ মোট তিন জন নির্দল প্রার্থী ছিলেন। যাঁরা প্রত্যেকেই তৃণমূলের ‘ডামি’ বলে দলের অন্দরে ধারণা। তবে আনুষ্ঠানিক ভাবে সে কথা কেউই স্বীকার করেননি (এমন ক্ষেত্রে তা প্রত্যাশিতও নয়)। বরং সুজয়কৃষ্ণের মতো প্রত্যেক প্রার্থীই নিজেকে ‘আসল’ প্রার্থী বলে দাবি করেছেন।
সুজয়কৃষ্ণ সম্প্রতি আনন্দবাজার অনলাইনকে জানিয়েছিলেন, ‘মমতাপ্রীতি’ থেকেই তিনি ভোটে মুখ্যমন্ত্রীর ‘বিরুদ্ধে’ দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘ব্যালট পেপারে আমার নাম যাতে মমতার পাশে জায়গা পায়, সেই কারণেই আমি ভবানীপুর থেকে তাঁর বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম।’’ তার পরে সুজয়কৃষ্ণের নাম কেউ শোনেননি। আচমকাই নিয়োগ দুর্নীতির প্রশ্নে ‘কালীঘাটের কাকু’র নাম প্রসঙ্গ আসে। দেখা যায়, ওই ‘কাকু’ হলেন সুজয়কৃষ্ণ।
বুধবার সকাল ১১টা নাগাদ নিজাম প্যালেসে সিবিআইয়ের দফতরে পৌঁছন সুজয়কৃষ্ণ। মঙ্গলবার সন্ধ্যাতেই তাঁকে নোটিস পাঠিয়েছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। সিবিআই দফতরে ঢোকার সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন দুই আইনজীবী। ঢোকার মুখে সুজয়কৃষ্ণ জানান, সকাল ১১টায় তাঁকে হাজির হওয়ার কথা বলা হয়েছিল নোটিসে। সেই তলবে সাড়া দিয়ে তিনি আইনজীবীকে নিয়ে এসেছেন। প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদ শেষে দুপুর ২টোর কিছু আগে সুজয়কৃষ্ণ নিজাম প্যালেস থেকে বেরিয়ে যান।
নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে ধৃত তাপস মণ্ডল প্রথম সুজয়ের নাম প্রকাশ্যে আনেন। পরে তাঁর নাম উঠে এসেছিল গোপাল দলপতি ওরফে আরমান গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখেও। তাপস জানিয়েছিলেন, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর হাতে ধৃত হুগলির বলাগড়ের যুব তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষের কাছে তিনি ‘কালীঘাটের কাকু’র কথা শুনেছিলেন। তাঁর দাবি, কুন্তল ‘কালীঘাটের কাকু’র কাছে টাকা পাঠানোর কথা বলেছিলেন। যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সুজয়। সিবিআই সূত্রে খবর, তদন্তেও বার বার সুজয়ের নাম উঠে এসেছে। তার পরেই ভবানীপুরে একদা মুখ্যমন্ত্রী মমতার বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়ানো সুজয়কে তলব করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে সিবিআই সূত্রে খবর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy