প্রয়াত সোমেন মিত্রকে মাল্যদান সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের (মাঝে)। বৃহস্পতিবার বিধান ভবনে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
সেটা ছয়ের দশকের শেষ দিকে হবে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমর্হাস্ট স্ট্রিটে মঞ্চ বেঁধে একটা সংবর্ধনা দিচ্ছে প্রিয়দা (প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি)। মঞ্চে প্রফুল্ল সেন আছেন। আর একটা আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে ছাড়া পাওয়া গোকুল বলে এক জন এবং সঙ্গে আরও একটি মুখ। সে দিন দেখে স্বাধীনতা সংগ্রামী মনে হচ্ছিল! পরে জানলাম, কংগ্রেসের বীর যোদ্ধা হিসেবে ওদের সে দিন অভ্যর্থনা জানাল প্রিয়দা।
গোকুলের পাশে সে দিন আমর্হাস্ট স্ট্রিটের মঞ্চে যাকে দেখেছিলাম, তারই মরদেহে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলাম বৃহস্পতিবার। সোমেন মিত্র কত দিনের রাজনৈতিক সহকর্মী, বন্ধু আমার। ওকে শেষ বার দেখব বলে বিধান ভবনেও গেলাম কত দিন পরে! বয়সে আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়। আমি নাম ধরেই ডাকতাম। পার্টি অফিসে ও আমাকে ডাকত ‘কুড়ো’ বলে। বাইরে সুব্রত।
এত গুলো বছর। লম্বা সময়। সব কথা এক ধাক্কায় মনেও পড়ে না আর। মনে আছে, প্রিয়দা আমাকে বিধানসভায় দাঁড় করিয়ে বিধায়ক করাল ১৯৭১ সালে। পরের বছর সোমেনকে। তখনকার বিধায়ক বিনয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম কেটে শিয়ালদহে সোমেনের জন্য টিকিট জোগাড় করেছিল প্রিয়দা। ইয়ং টিম গড়ার ঝোঁক ছিল প্রিয়দা’র। সেই আমাদের পথ চলার শুরু।
আরও পড়ুন: শ্রীসোমেন্দ্রনাথ মিত্র (১৯৪১-২০২০)
কংগ্রেস রাজনীতিতে প্রিয় আর সোমেনের দু’টো শিবির ধীরে ধীরে মিথ হয়ে গিয়েছে। আমাদের শুরু কিন্তু প্রিয়দা’র হাত ধরেই। পরে শত ঘোষের টিমে সোমেনের যাওয়া, আমাদের ছাত্র পরিষদের সমান্তরালে ‘শিক্ষা বাঁচাও কমিটি’ করা— এ সবের ফলে আস্তে আস্তে শিবির ভাগ হয়েছিল। তবে আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল আজীবন। একে অপরের বাড়ি যাওয়া, আমার পুজোয় ওর আসা, বাইরে গেলে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, আমি হাসপাতালে ভর্তি হলে ওর দেখতে আসা— ছেদ পড়েনি ব্যক্তিগত সম্পর্কে। আর যেটা কখনও ভুলব না, আমার বাবা যে দিন চলে গেলেন, আমি কলকাতায় ছিলাম না। আমার বাড়িতে এসে দাঁড়িয়ে থেকে সব কাজ করিয়েছিল বন্ধু সোমেন।
কী বলব সোমেন সম্পর্কে? সংগঠন আর কর্মী-অন্তঃপ্রাণ নেতা। নিজের কোনও বাসনা নেই। থাকলে মমতা (বন্দ্যোপাধ্যায়) ওকে নিয়ে সুযোগ দিয়ে সাংসদ করার পরে ও আবার সব ছেড়ে দিয়ে কংগ্রেসে ফিরে যেত না। ও বলত, ওর কাজ নাকি হয়ে গিয়েছে। শিয়ালদহ থেকে ৭ বার বিধায়ক হয়েছে কিন্তু আমি দেখেছি, এমপি-এমএলএ হওয়ার ওর কোনও আকাঙ্খা ছিল না। কংগ্রেসি ঘরানায় এই পদগুলোর গুরুত্ব আছে বলে একটা রেখেছিল, এই পর্যন্ত। বিধানসভায় আমরা যখন নানা কাণ্ড ঘটাচ্ছি, ও বেশির ভাগ দিন আসতই না! বলত, চল জেলায় যাই। জেলায় ঘুরবে, সংগঠন দেখবে, এতেই ওর আনন্দ ছিল। প্রিয়দা’র মতো বক্তৃতা করে মানুষকে টেনে রাখার ক্ষমতা ওর ছিল না। ও-ও ভাষণবাজির দিকে না গিয়ে সংগঠন আর কর্মী গড়ে তোলায় মন দিত। আমরা চাঁদা দিয়েছি কিন্তু প্রদেশ কংগ্রেসের এখনকার দফতর ‘বিধান ভবন’ গড়ে উঠেছিল ওরই ঐকান্তিক উদ্যোগে।
আরও পড়ুন: প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি পদে এ বার কে?
দিল্লির রাজনীতিতে যাব, বড় করে ছড়ি ঘোরাব, এমন স্বপ্ন সোমেনের ছিল বলে মনে হয়নি। শিয়ালদহ আর কংগ্রেসের সংগঠন নিয়েই ও খুশি। দিল্লিতে অনেক বার অনেকগুলো দিন একসঙ্গে কেটেছে। বঙ্গ ভবনে সোমেনের জমিয়ে মাংসভাত আর দিবানিদ্রা ভুলব না!
আরও পড়ুন: ঘটির মেয়ের রান্না খেয়েই মাত সোমেন
সিপিএমের সঙ্গে লড়াই করে রাজনীতি করেছি। সেই সিপিএমের সঙ্গে সমঝোতা কংগ্রেসের কিছু অংশ মানতে পারেনি। আমিও বলেছি সে কথা। সোমেন প্রদেশ সভাপতি হিসেবে বড় দায়িত্বে ফিরে গিয়ে সেই সমঝোতা আরও পোক্ত করার দিকে মন দিয়েছিল। ওর নিজস্ব যুক্তি ছিল। সে সব কথা থাক।
কর্মীদের আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়িয়ে সংগঠনকে গড়ে তোলা, টিম তৈরি করার রাজনৈতিক সংস্কৃতি ধীরে ধীরে দুর্বল হচ্ছে। সেই সংস্কৃতির এক প্রতীক প্রিয়দা চলে গিয়েছে। সোমেনও আজ থেকে অতীত।
যেখানেই থাক, ভাল থাক বন্ধু!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy