বদলি করা হল আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে ডাক্তারদের আন্দোলনের অন্যতম অগ্রণী সুবর্ণ গোস্বামীকে। এত দিন পূর্ব বর্ধমানের ডেপুটি সিএমওএইচ (উপ মুখ্য জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক) ২ পদে কর্মরত ছিলেন সুবর্ণ। এ বার তাঁকে বদলি করা হল দার্জিলিঙের টিবি হাসপাতালে। সেখানে তাঁকে সুপার পদে পাঠানো হয়েছে।
এই বদলিতে তাঁর পদাবনতি হয়েছে বলেই দাবি করেছেন সুবর্ণ। আনন্দবাজার ডট কম-কে তিনি বলেন, ‘‘আমার যা র্যাঙ্ক, তার চেয়ে নীচের র্যাঙ্কের একটি পদে বদলি করা হল। এমন একটা জায়গায়, এমন একটা কাজের জন্য পাঠানো হচ্ছে, যেখানে করার মতো কিছু নেই। সে কারণেও এটাকে পদে অবনতি বলেই মনে করছি।’’ সুবর্ণের সংযোজন, আরজি কর আন্দোলনের সামনের সারিতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের উপর তো নানা ভাবে প্রতিহিংসা চলছে। থানায় মিথ্যা অভিযোগ হচ্ছে। বার বার ডেকে পাঠানো হচ্ছে কখনও লালবাজার থেকে, কখনও ইলেক্ট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানা থেকে। এ বার বদলি করা হল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললেই এ সব হয়।’’
অতীতেও একাধিক বার বদলি হয়েছেন আরজি করের প্রাক্তনী সুবর্ণ। তাঁর চাকরিজীবন শুরু ২০০৪ সালে। তখন তিনি বীরভূমের মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন। সেখানে সিউড়ি-২ ব্লকের তৎকালীন ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিকের বিরুদ্ধে ওষুধ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। বাম আমলের পর তৃণমূল জমানাতেও একাধিক বার স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরব হতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। সুবর্ণের দাবি, এর জন্য একাধিক বার সরকারের রোষে পড়তে হয়েছে তাঁকে। চিকিৎসক বলেন, ‘‘এই নিয়ে তৃণমূলের আমলে অষ্টম বার বদলি করা হল আমাকে। আমরা সরকারি চাকুরে। বদলির জন্য আমাদের তৈরি থাকতে হয়। এ বার দার্জিলিঙে পাঠানো হল। এর পর দার্জিলিং থেকে অন্য জায়গায় পাঠানো হবে।’’
আরও পড়ুন:
যে সব সিনিয়র চিকিৎসক আরজি কর আন্দোলনের জুনিয়র চিকিৎসকদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রশাসনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে সুবর্ণ অন্যতম। কখনও তাঁকে দেখা গিয়েছিল জুনিয়র ডাক্তারদের মিছিলে গিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সুর চড়াতে, কখনও ধর্মতলায় জুনিয়র ডাক্তারদের অনশনমঞ্চে। সুবর্ণ সেখানে ‘প্রতীকী’ অনশনও করেছিলেন। তাঁকে এক বার তলবও করেছিল কলকাতা পুলিশ। কিন্তু সুবর্ণকে থামানো যায়নি। জুনিয়র ডাক্তারদের ডাকে কলেজ স্কোয়্যার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত মিছিলে প্রধান সংগঠক হিসাবে হাজির থেকেছিলেন তিনি। বর্ধমান শহরের কার্জন গেট চত্বরে আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের কর্মসূচিতে অংশও নিয়েছিলেন। কলকাতায় রানি রাসমণি রোডে ‘দ্রোহের কার্নিভাল’ কর্মসূচিতেও সামনের সারিতে ছিলেন তিনিই। এর জেরে শাসকদলের রোষে পড়েছিলেন সুবর্ণ। তারা সমাজমাধ্যমে চিকিৎসককে ‘বিচিত্রবীর্য’ বলে কটাক্ষ করতে শুরু করেছিলেন সেই সময়। সৌজন্যে অবশ্য সুবর্ণেরই একটি মন্তব্য।
আরজি করের নির্যাতিতার দেহের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর তিনি বলেছিলেন, ‘‘সতীচ্ছদা (হাইমেন)-র ভিতর থেকে ১৫০ গ্রামের বেশি লিকুইড স্যাম্পল (তরল নমুনা) পাওয়া গিয়েছে। এটা হয়তো রক্তমাখা বীর্য।’’ যদিও জনস্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসক সুবর্ণ আনন্দবাজার ডট কম-কে জানিয়েছিলেন, তিনি কখনওই ওই কথা বলেননি। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘‘আমি ১৫০ গ্রাম বীর্যের কথা কখনও বলিনি। আমি বলেছিলাম, ১৫০ গ্রামের, মোস্ট স্পেসিফিক্যালি (নির্দিষ্ট ভাবে) ১৫১ গ্রামের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। যার মধ্যে তরল সাদা চটচটে পদার্থ পাওয়া গিয়েছে। মানে ময়নাতদন্তে যেমন লেখা হয়েছে— হোয়াইট ভিসিড ফ্লুইড। আমি ওটাই বলেছিলাম যে, ওই তরল পদার্থের যদি ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়, তা হলে তা বীর্য হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর যদি বীর্য হয়, ডিএনএ ম্যাচিং করলে বোঝা যাবে, দলবদ্ধ ধর্ষণ হয়েছে কি না।’’
প্রসঙ্গত, গত জানুয়ারি মাসে শিয়ালদহ আদালতে আরজি করে ধর্ষণ-খুনের মামলার রায় দিয়েছিল শিয়ালদহ আদালত। সেখানে দোষী সাব্যস্ত করে আজীবন কারাবাসের শাস্তি শোনানো হয়েছে ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে।
শুধু ‘রক্তমাখা বীর্য’ মন্তব্যই নয়, ২০০১ সালে আরজি করে সৌমিত্র বিশ্বাস নামে এক চিকিৎসক-পড়ুয়ার ‘রহস্যমৃত্যু’ নিয়েও ডাক্তার আন্দোলনের আবহে আসরে নেমেছিল তৃণমূল। পড়ুয়ামৃত্যুর সেই ঘটনায় সুবর্ণ-সহ এসএফআইয়ের কয়েক জনের নাম জড়িয়েছিল বলে দাবিও করেছিল শাসকদল। সুবর্ণ অবশ্য দাবি করেছিলেন, ‘‘আমি ঘটনার সময় এসএফআইয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। আমার ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করে চিকিৎসকদের আন্দোলন দমানো যাবে না।’’