Advertisement
E-Paper

ডাক্তার-আন্দোলনে অগ্রণী, তৃণমূল ডাকে ‘বিচিত্রবীর্য’! ২০ বছরে ১৩ বার বদলি হলেও ‘স্বস্তি’ই পান সুবর্ণ

‘১৫০ গ্রাম বীর্য’ বিতর্ক নিয়ে আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে মুখ খুললেন ডাক্তারদের আন্দোলনের ‘পথপ্রদর্শক’ সিনিয়র চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী। ব্যাখ্যাও দিলেন সেই বিতর্কিত মন্তব্যের।

Subarna Goswami, the face of the doctors\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\' movement in West Bengal, has been transferred 13 times in last 20 years

চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

প্রণয় ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:৫৬
Share
Save

আরজি কর আন্দোলনের জুনিয়র ডাক্তারেরা তাঁকে ‘পথপ্রদর্শক’ মনে করেন। শাসকদলের লোকেরা তাঁর নাম দিয়েছেন ‘বিচিত্রবীর্য’! তিনি পেশায় সরকারি চিকিৎসক। বর্তমানে পূর্ব বর্ধমানের ডেপুটি সিএমওএইচ (উপ মুখ্য জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক) পদে কর্মরত। গত ২০ বছরে ১৩ বার বদলি হয়েছেন। তার মধ্যে বাম আমলে চার বার। ন’বার তৃণমূল জমানায়। বিভিন্ন সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতি, কাজে না যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আবার তাঁর বদলি রুখতে জাতীয় সড়ক ‘অবরোধ’ করার ঘটনাও ঘটেছে।

তিনি সুবর্ণ গোস্বামী।

যে সব সিনিয়র চিকিৎসক আরজি কর আন্দোলনের জুনিয়র চিকিৎসকদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রশাসনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সুবর্ণ অন্যতম। কখনও তাঁকে দেখা গিয়েছে জুনিয়র ডাক্তারদের মিছিলে গিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সুর চড়াতে। কখনও ধর্মতলায় জুনিয়র ডাক্তারদের অনশনমঞ্চে। সুবর্ণ সেখানে ‘প্রতীকী’ অনশনও করেছেন। তাঁকে এক বার তলবও করেছিল কলকাতা পুলিশ। কিন্তু সুবর্ণকে থামানো যায়নি। জুনিয়র ডাক্তারদের ডাকে কলেজ স্কোয়্যার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত মিছিলে প্রধান সংগঠক হিসাবে হাজির থেকেছেন। বর্ধমান শহরের কার্জন গেট চত্বরে আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। কলকাতায় রানি রাসমণি রোডে ‘দ্রোহের কার্নিভাল’ কর্মসূচিতেও সামনের সারিতে তিনিই।

তাঁকে ঘিরে প্রশ্ন উঠছে, বর্ধমানে কর্মরত হওয়া সত্ত্বেও কী ভাবে দিনের পর দিন কলকাতায় থাকছেন তিনি? জবাবে সুবর্ণ বলেন, ‘‘এই আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে আমার বিরুদ্ধে অনেক মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে। এটাও তার মধ্যে একটা। অনেক চিকিৎসক তাঁর কর্মস্থল থেকে নিয়মিত যাতায়াত করছেন। আমিও তা-ই। আমি আমার কাজ শেষ করে বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করি। এ ছাড়া ছুটির দিনের কর্মসূচিতে যোগ দিই। কোনও দিন কাজে ফাঁকি দিয়ে অন্য কিছু করিনি।’’

আশ্চর্য নয় যে, শাসকদল তাঁকে ‘টার্গেট’ করবে। তারা সমাজমাধ্যমে সুবর্ণকে ‘বিচিত্রবীর্য’ বলতে শুরু করেছে। সৌজন্য অবশ্য সুবর্ণেরই একটি মন্তব্য।

আরজি করের নির্যাতিতার দেহের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর তিনি বলেছিলেন, ‘‘সতীচ্ছদা (হাইমেন)-র ভিতর থেকে ১৫০ গ্রামের বেশি লিকুইড স্যাম্পল (তরল নমুনা) পাওয়া গিয়েছে। এটা হয়তো রক্তমাখা বীর্য।’’

সুবর্ণের ওই মন্তব্য শোরগোল ফেলে চারদিকে। পুলিশ মহলের একাংশ রসিকতা করে একান্ত আলোচনায় বলতে থাকে, ‘‘১৫০ গ্রাম বীর্য পেতে ৬০ খানা ষাঁড় লাগবে!’’ সেই সূত্রেই শাসক তৃণমূলের সমাজমাধ্যম বিশারদেরা সুবর্ণের নাম দিয়ে দেন ‘বিচিত্রবীর্য’। সেই নামে তাঁর নামে নিয়মিত পোস্টও করা হতে থাকে।

জনস্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসক সুবর্ণ অবশ্য আনন্দবাজার অনলাইনকে জানিয়েছেন, তিনি কখনওই ওই কথা বলেননি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমি ১৫০ গ্রাম বীর্যের কথা কখনও বলিনি। আমি বলেছিলাম, ১৫০ গ্রামের, মোস্ট স্পেসিফিক্যালি (নির্দিষ্ট ভাবে) ১৫১ গ্রামের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। যার মধ্যে তরল সাদা চটচটে পদার্থ পাওয়া গিয়েছে। মানে ময়নাতদন্তে যেমন লেখা হয়েছে— হোয়াইট ভিসিড ফ্লুইড। আমি ওটাই বলেছিলাম যে, ওই তরল পদার্থের যদি ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়, তা হলে তা বীর্য হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর যদি বীর্য হয়, ডিএনএ ম্যাচিং করলে বোঝা যাবে, দলবদ্ধ ধর্ষণ হয়েছে কি না।’’

কিন্তু বীর্য পরিমাপের একক কি ‘গ্রাম’ না ‘মিলিগ্রাম’? সুবর্ণের জবাব, ‘‘যারা এই প্রশ্ন তুলছে, তারা মেডিক্যাল সায়েন্সটা জানে না! ফরেন্সিক সায়েন্সও জানে না। ময়নাতদন্তের রিপোর্টও দেখেনি। এই অজ্ঞতা থেকেই তৃণমূলের আইটি সেল ওই সব প্রচার করছে। ওদের যা শেখানো হচ্ছে, ওরা সেই বুলিই আওড়াচ্ছে।’’

প্রসঙ্গত, আনন্দবাজার অনলাইনের হাতেও ময়নাতদন্তের যে রিপোর্ট এসেছিল, তাতে কোথাও ‘সিমেন’ শব্দের উল্লেখ ছিল না। লেখা ছিল, নির্যাতিতার ‘এন্ডোসার্ভিক্যাল ক্যানাল’ থেকে ‘সাদা ঘন চটচটে তরল’ সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে সেই তরল কী, তার উল্লেখ ছিল না রিপোর্টে। রিপোর্টে ‘এক্সটার্নাল অ্যান্ড ইন্টারনাল জেনিটালিয়া’ কলামে লেখা ছিল ওজন ‘১৫১ গ্রাম’। নিয়ম হল, ময়নাতদন্তের রিপোর্টে মৃতদেহের বিভিন্ন অংশের ওজন উল্লেখ করা হয়। সে ক্ষেত্রেও তা-ই করা হয়েছিল।

আরজি করের প্রাক্তনী সুবর্ণের চাকরিজীবন শুরু ২০০৪ সালে। তখন তিনি বীরভূমের মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন। সিউড়ি-২ ব্লকের তৎকালীন ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিকের বিরুদ্ধে ওষুধ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন। সুবর্ণ জানান, ওই বিষয়ে তিনি তৎকালীন সাংসদ রামচন্দ্র ডোমের কাছেও অভিযোগ জানিয়েছিলেন। তাতে কাজ না হওয়ায় তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যক্রান্ত মিশ্রের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘বাম আমলেও দুর্নীতি হয়েছে। তৃণমূল আমলেও হচ্ছে। ২০২১ সালের আগে দুর্নীতির একটা চেহারা ছিল। কিন্তু ২০২১ সালের পর স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নিয়োগে বড় দুর্নীতি হতে শুরু করল। শাসকদলের লোকেরা ভূরি ভূরি চাকরি পেয়েছে। ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে। আমি তার প্রতিবাদ করেছি। তাই আমায় কোথাও স্থায়ী ভাবে থাকতে দেওয়া হয়নি।’’

তৃণমূলের মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তী অবশ্য পাল্টা বলছেন, ‘‘দুর্নীতির কথা বলতে ওঁর ২০২১ বা তার আগের কথা মনে পড়ছে কেন? কেন ২০০৩ নয়? তখন উনি আরজি করে এসএফআই করতেন বলে? তাঁদের সময়ের কথা মনে পড়ছে না কেন? সেই সময় পর্নচক্র চলার অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে। ডাক্তার-পড়ুয়া খুনের ঘটনাও প্রকাশ্যে এসেছে। আসলে চিরকালই চোরের মায়ের বড় গলা হয়। এই বিচিত্রবীর্যদেরও তেমন বড় গলা!’’

সম্প্রতি আরজি কর-কাণ্ডের আবহে ২০০১ সালে সৌমিত্র বিশ্বাস নামে এক চিকিৎসক-পড়ুয়ার ‘রহস্যমৃত্যু’ নিয়ে আসরে নেমেছে তৃণমূল। সেই ঘটনায় এসএফআইয়ের কয়েক জনের নাম জড়িয়েছিল। সেই ঘটনাতেই সুবর্ণের নাম নিয়ে অভিযোগ শুরু করেছে শাসক শিবির। সুবর্ণের অবশ্য দাবি, ‘‘আমি ঘটনার সময় এসএফআইয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। আমার ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করে চিকিৎসকদের আন্দোলন দমানো যাবে না।’’

সুবর্ণ জানাচ্ছেন, ২০১৩ সালে কলকাতা পুরসভার ১০ নম্বর বরো এলাকায় ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘কমিউনিটি হেল্‌থ অ্যাডভাইজ়ার’ করে পাঠানো হয়েছিল তাঁকে। সেখানে তাঁর কাজের প্রশংসা করেন শাসকদলের নেতা তথা তৎকালীন বরো চেয়ারম্যান। তার পরেই মালদহের চাঁচল হাসপাতালে বদলি করা হয় তাঁকে। তখন ওই হাসপাতালে সুপার পদ না-থাকায় তাঁকে ‘ভারপ্রাপ্ত সুপার’ করে স্বাস্থ্য ভবন। কিন্তু ছ’মাসের মধ্যেই তাঁকে বাঁকুড়ায় বদলি করা হয়। সুবর্ণের দাবি, তখন তাঁর বদলির প্রতিবাদ করেছিল বিজেপি-তৃণমূল-সিপিএমের যৌথ মঞ্চ। তার জেরেই বদলির নির্দেশ তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর তাঁকে বাঁকুড়ায় বদলি করা হয়। সুবর্ণ বলেন, ‘‘গণবিক্ষোভের ভয়ে আমায় চাঁচল হাসপাতাল থেকে রিলিজ় পর্যন্ত নিতে দেওয়া হয়নি।’’ তবে সেই ঘটনা নিয়ে তখন স্বাস্থ্য ভবনে কর্মরত এক কর্তার বক্তব্য, ‘‘সুবর্ণ গোস্বামী এলাকার মানুষকে উস্কে দিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করার চেষ্টা করছিলেন। স্বাস্থ্য ভবন সেটা বুঝতে পেরে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়।’’

২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাঁকুড়া হাসপাতালে ছিলেন সুবর্ণ। তাঁর দাবি, জেলার এক শীর্ষ স্বাস্থ্যকর্তার সঙ্গে মতানৈক্যের জেরে তাঁকে আলিপুরদুয়ারে বদলি করা হয়। আবার বাঁকুড়া জেলার স্বাস্থ্য দফতরের একটি সূত্রের পাল্টা দাবি, তখন সুবর্ণের বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ উঠেছিল। জেলার তৎকালীন এক স্বাস্থ্যকর্তা বলেন, ‘‘নিজের দায়িত্বের চেয়ে ইচ্ছার গুরুত্ব ওঁর কাছে বেশি ছিল। সমাজের কাছে ‘হিরো’ হতে গিয়ে নিজের কাজে গাফিলতি দেখিয়েছিলেন।’’

আলিপুরদুয়ারে পাঁচ বছর ছিলেন সুবর্ণ। ২০২০ সালে কোভিডের সময় তাঁকে বদলি করা হয় কার্শিয়াঙে। পরের বছরেই পাঠানো হয় বর্ধমানে। তার পর থেকে আপাতত সেখানেই রয়েছেন। আর বলছেন, ‘‘দুর্নীতি নিয়ে বার বার মুখ খুলেছি বলেই তো আমার এই অবস্থা! যখনই বদলির নির্দেশ আসে, বুঝতে পারি, ভাল কাজের পুরস্কার পেলাম। স্বস্তি পাই তখন।’’

কিন্তু ‘বিচিত্রবীর্য’ নামে স্বস্তি পান? সুবর্ণের জবাব, ‘‘আমরা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির মৌচাকে ঢিল মেরেছি! এ সব কটাক্ষ নিয়ে একটুও বিচলিত নই। এতে গুরুত্ব দিতেও নারাজ। যে সম্মান সমাজের কাছে, মানুষের কাছে পাই, তার কাছে এগুলো কোনও বিষয়ই নয়।’’

Subarna Goswami Junior Doctors\' Movement Transfer R G Kar Movement

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।