সল্টলেকে নিজের বাড়িতে চয়ন সমাদ্দার। —নিজস্ব চিত্র।
পরীক্ষার আগের দিন সারা রাত জেগে অঙ্ক করেও পরের দিন অঙ্ক পরীক্ষায় বসে হিন্দু স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রটি দেখল, বেশির ভাগ অঙ্কই সে পারছে না। তা হলে কি অঙ্কে ফেল করবে? অঙ্কে ফেল করলে প্রথম তিনের মধ্যে থেকে নবম শ্রেণিতে উঠতে পারবে না যে! শিক্ষকেরা কী বলবেন? বাড়ির লোক কী বলবেন? এই চাপ নিতে পারেনি ছাত্রটি। পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে স্কুলেরই চারতলার একটি রেলিং না-থাকা জানলা দিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিল সে। একটি বইয়ের দোকানের প্লাস্টিকের ছাউনির উপরে পড়ায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। তবে হাত-পা ভেঙে যায় তার। পায়ে চোট পান দোকানদার।
হিন্দু স্কুলে ঘটনাটি ঘটেছিল বছর তেত্রিশ আগে, ১৯৮৬ সালের ২৬ নভেম্বর। বুধবার সল্টলেকে এফডি ব্লকের নিজের ফ্ল্যাটে বসে সেই ছাত্র চয়ন সমাদ্দার বললেন, ‘‘সে-দিন অঙ্ক পরীক্ষায় বসে কোনও উত্তর দিতে না-পেরে মনে হয়েছিল, জীবন থেকে পালাই। মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব শিক্ষক— সকলের থেকে পালাই। কিন্তু আমি ফিরে এসেছিলাম ভাগ্যের জোরে। এখন মনে হচ্ছে, ভাগ্যিস, ফিরতে পেরেছি জীবনে! এখন বুঝতে পারি, একটা অঙ্ক পরীক্ষা খারাপ হওয়ায় জীবন শেষ হয়ে যায় না। স্কুলশিক্ষকতা ছাড়াও লেখালেখি করি। গল্পের বই বেরিয়েছে। চমৎকার জীবন উপভোগ করছি।’’
চয়নবাবু জানান, তাঁদের সময় হিন্দু স্কুলে পড়াশোনার চাপ ছিল মারাত্মক। স্কুলে ভাল ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন বরাবর। তাই তাঁর উপরে ভাল ফল করার চাপ ছিল খুব বেশি। তিনি পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠেন প্রথম হয়ে। ষষ্ঠ থেকে তৃতীয় হয়ে ওঠেন সপ্তমে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টমে ওঠেন চতুর্থ হয়ে। তখন স্কুলের শিক্ষকেরা বলাবলি শুরু করেন, চয়ন ভাল ছাত্র ঠিকই। কিন্তু যত বড় হচ্ছে, পড়াশোনায় মনোযোগ কমে যাচ্ছে।
চয়নবাবু বলেন, ‘‘অষ্টম থেকে নবমে উঠতে ভাল ফল করতেই হবে। প্রথম তিনের মধ্যে থাকতেই হবে। এই একটা মারাত্মক চাপ আমার মধ্যে অজান্তেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। খুব খেটেছিলাম অঙ্কের জন্য। কিন্তু পরীক্ষায় বসে কোনও উত্তরই ঠিকমতো দিতে পারছি না দেখে ভেঙে পড়েছিলাম।’’ চয়নবাবু জানান, তাঁর বাবা রমাপ্রসাদ সমাদ্দার সেই সময় ছিলেন ডব্লিউবিসিএস অফিসার। তিনি অঙ্কে খুব ভাল ছিলেন।
অঙ্কে ছেলে খারাপ করছে, এটা তিনিও কোনও মতেই মানতে পারছিলেন না।
অষ্টম শ্রেণির সেই অঙ্ক পরীক্ষায় চয়নবাবু পেয়েছিলেন ২৭। পরেও অঙ্ক পরীক্ষায় কোনও দিনই ভাল ফল করতে পারেননি। ‘‘কলেজে উঠে ঠিক করে ফেলি, ইংরেজি পড়েই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হব। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়া শুরু করে নতুন করে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম,’’ বললেন চয়নবাবু।
বাগুইআটি এলাকার সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত অশ্বিনীনগর জে এন মণ্ডল ইনস্টিটিউশনে চয়নবাবু এখন ইংরেজি পড়ান। তিনি বলেন, ‘‘কুড়ি বছর শিক্ষকতা করছি। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি, যদি পরীক্ষার নম্বরটাকেই ছাত্রছাত্রীদের কাছে পাখির চোখ করে দিই, সেটা তাদের কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই নম্বরের জন্য ওদের উপরে কোনও চাপ দিই না। বরং পড়াশোনা বাদে অন্য ছোটখাটো কাজ, যেমন,
কেউ যদি দেওয়াল পত্রিকায় ভাল কবিতা লেখে, কেউ স্কুলে ভাল বাগান করে, তখন ওদের খুব প্রশংসা করি। আমাকে বন্ধুর মতো অনেক সমস্যার কথা বলে ওরা।’’
বাবা মারা গিয়েছেন। ফ্ল্যাটে মা স্মৃতিদেবীর সঙ্গে থাকেন চয়নবাবু। ‘‘সে-দিনের ঘটনার কথা মনে করতে চাই না। জীবনে ও যা হতে পেরেছে, তাতেই আমি খুব খুশি। ছেলে আনন্দে আছে, এটাই আমার সব থেকে বড় প্রাপ্তি,’’ বলছেন স্মৃতিদেবী।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy