আনন্দাশ্রু। কাঁদতে কাঁদতেই ছেলের চোখের জল মুছিয়ে দিলেন নুরউদ্দিন হালদারের মা। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
প্রথম দিন পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময়েই অটোর ধাক্কা। মারাত্মক জখম হল ডান হাত। সবাই ধরেই নিয়েছিল, মেয়েটার এ বার আর পরীক্ষা দেওয়া হবে না। গার্ডেনরিচ মুদিয়ালি বালিকা বিদ্যালয়ের মৌবনি রেজ-এর হাতে চার বার অস্ত্রোপচার হয়েছে। হাসপাতালে শুয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল সে। জীবন বিজ্ঞানে লেটার নিয়ে সাফল্যের সঙ্গে পাশ করেছে মৌবনি।
এ বারের মাধ্যমিকে সফল পরীক্ষার্থীদের মধ্যে মৌবনির সঙ্গে রয়েছে আরও এক ঝাঁক মুখ, যারা প্রত্যেকে ডিঙিয়ে গিয়েছে প্রতিকূলতার পাহাড়। মালদহের মানসী প্রামাণিক মেধা তালিকার অষ্টম স্থানে। কলকাতার ক্যানেল ইস্ট রোডের নুরউদ্দিন হালদার, পশ্চিম মেদিনীপুরের সুজাতা দাস, বর্ধমানের শেখ রাজু, মালবাজারের স্বরণ চক্রবর্তী, শিলিগিড়ির পার্থ রায়ও দারিদ্রকে হারিয়েই ভাল নম্বর পেয়ে পাশ করেছে। তবে জীবনের বড় পরীক্ষার প্রথম দিনই এমন দুর্ঘটনার পরে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে গিয়ে মৌবনিই এ বারের ম্যান অব দ্য ম্যাচ।
মৌবনির কথা
দিনটা ১ ফেব্রুয়ারি। গার্ডেনরিচের শিবনগরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে অটো ধরেছিল মেয়েটা। অটোতে বসেই বাংলা বইয়ের পাতা উল্টে নিচ্ছিল। এমন সময় উল্টো দিক থেকে অন্য একটি অটো ছুটে এসে ধাক্কা মারল সটান। মৌবনির বাবা ববিত রেজ বলছিলেন, ‘‘চোখের সামনে দেখলাম মেয়ের ডান হাতের মাংস ঝুলে গিয়েছে। রক্তাক্ত অবস্থায় চিৎকার করছে ও। আমি ওই ঝুলে পড়া মাংস হাতে চেপে সামনে একটি নার্সিং হোমে নিয়ে যাই। তার পরে হাসপাতালে। তখনও মৌ বলে যাচ্ছিল পরীক্ষা দিতে চায়।’’ হাসপাতালে আধশোয়া হয়ে, রাইটার নিয়ে পরীক্ষা দেয় মৌবনি। শুধু প্রথম দিন নয়, প্রতিদিনই। তার মধ্যেই চার বার অস্ত্রোপচার। হাতে সেলাই। ড্রেসিং, সঙ্গে ব্যথা কমানোর ইঞ্জেকশন সকাল-বিকেল। মৌবনি বলে, ‘‘বাংলা পরীক্ষার আগে তো অস্ত্রোপচার করারও সুযোগ পাননি ডাক্তারবাবুরা। দম নিতে পারছিলাম না। কিন্তু হাল ছাড়িনি।’’ আরও ভাল নম্বর হওয়া উচিত ছিল, এটাই এখন আক্ষেপ ওর। মৌবনির প্রধান শিক্ষিকা সান্ত্বনা সেনশর্মা অবশ্য নম্বর নিয়ে ভাবছেনই না। তিনি বললেন, ‘‘প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে থেকে যে সেরাটা দিতে পারে, সেটাই হল আসল শিক্ষা। সেই শিক্ষায় মৌ উত্তীর্ণ।’’
মানসী লড়বে
ফুটপাথের উপরে টিনের ঝুপড়ি সেলুন। দিন খুব ভাল গেলে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা উপার্জন। মালদহে গাজলের সুকান্তপল্লির বাসিন্দা সেই পরিবারেরই মেয়ে মানসী প্রমাণিক এ বারে মাধ্যমিক পরীক্ষায় রাজ্যের মধ্যে অষ্টম। মেয়ের সাফল্যে গর্বিত হলেও কপালে চিন্তার ভাঁজ বাবা নিরঞ্জন প্রমাণিকের। মেয়ের পড়াশুনোর খরচ কোথা থেকে আসবে! মানসী কিন্তু চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। ‘‘আমাকে পড়াতে বাবা-মাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হচ্ছে। তবু আমার ইচ্ছে এক দিন চিকিৎসক হব। এত দিন লড়াই করেছি। আরও করব।’’
রাজুর স্বপ্ন
৬৬৫ নম্বর পেয়েছে ভাতারের বামশোর হাইস্কুলের ছাত্র শেখ রাজু। বাবা স্থানীয় একটি লোহা কারখানায় দিনমজুরের কাজ করেন। খড় ছাওয়া মাটির ঘরে তিন ভাই, বাবা-মা মিলে পাঁচ জনের সংসার। ইংরেজি আর অঙ্কের জন্য গৃহশিক্ষক থাকলেও বাকি পড়াশোনা নিজেই করত রাজু। সাহায্য করত কলেজপড়ুয়া দাদা। রাজু সব বিষয়েই লেটার পেয়েছে। বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। আনন্দের মধ্যেও বাবা আমোদ আলি খরচের চিন্তায় ব্যস্ত। বললেন, ‘‘কী করে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াব তাই ভাবছি।’’
স্বরণ এগোবে
সবেধন নীলমণি একটিই ঘর। দেওয়াল থেকে ইটের পাঁজর বেরিয়ে আছে। কোনও মতে একটা টিউব লাইট ঝুলছে। দুপুরে খাবার বলতে সেদ্ধ ভাত। এখানেই পড়াশোনা করে ৬১৬ পেয়েছে স্বরণ চক্রবর্তী। মালবাজারের আদর্শ বিদ্যাভবনের ছাত্র। বাবা দেবদূত চক্রবর্তী শহরের পথে পথে শিস দিয়ে স্বর্ণযুগের গানের সুর শুনিয়ে বেড়ান। সংসার সামলানোর দায়িত্ব স্বরণের মা দোলাদেবীর কাঁধেই। তিনি জানালেন, জাতীয় সড়কের দিকে মুখ করে ছোট গুমটি দোকান রয়েছে তাঁদের। সেই দোকান ভাড়ার উপার্জনটাই সম্বল।
পার্থর সংশয়
তিন ভাইবোন নিয়ে বাড়িতে পাঁচ জন সদস্য। বাবা পূর্ণদেব রায় শিলিগুড়ির সেবক রোডে একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে সামান্য বেতনে কাজ করেন। অধিকাংশ দিন স্কুলে যাওয়ার সময় খাওয়াই হয় না। টিফিন খাওয়ার পয়সাও থাকে না অধিকাংশ দিন। সেই পয়সা দিয়ে কিনতে হয় কলম বা খাতা। শিলিগুড়ির বরদাকান্ত বিদ্যাপীঠের ছাত্র পার্থ রায় পেয়েছে ৬২০। রুগণ ছেলেটি চায় ইঞ্জিনিয়ার হতে। কোথা থেকে পয়সা আসবে, জানেন না পূর্ণদেববাবু।
সুজাতার হাসি
মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের (গার্লস) ছাত্রী সুজাতা দাস মাধ্যমিকে ৫৮৪ নম্বর পেয়েছে। জীবনবিজ্ঞানে ৯১, ভৌতবিজ্ঞানে ৯০, অঙ্কে ৯৬। সুজাতা পড়াশোনা করতে চায় অঙ্ক নিয়ে। বড় হয়ে অধ্যাপিকা হওয়ার স্বপ্ন দেখে। সুজাতার বাবা সুকুমারবাবু পেশায় কুমোর। বাড়ি মেদিনীপুর শহরের মির্জাবাজার কুমোরপাড়ায়। কোনও রকমে সংসার চলে। রেজাল্ট দেখে সুজাতার উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির ফি মকুব করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান শিক্ষিকা মৌসুমী নন্দী। হাসি ফুটেছে সুজাতার মুখে।
নুরউদ্দিনের লড়াই
নিদারুণ আর্থিক দুর্দশার মধ্যেও যে লড়াই করা সম্ভব, প্রমাণ করেছে নুরউদ্দিন হালদার। বেলেঘাটার খালের পাশে ছোট্ট ঝুপড়ি। ভিতরে ঢুকে সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না। সেখানেই গাদাগাদি করে থাকেন বাবা-মা, দাদা-দিদি মিলে মোট সাত জন। ঘরে বিদ্যুৎ নেই, রোজ হাঁড়িও চড়ে না। বাবা বিছানা থেকে উঠতে পারেন না, চোখে দেখতে পান না। মা লোকের বাড়িতে কাজ করেন। দাদা ভ্যান চালান। এই অবস্থা থেকেও মাধ্যমিকে ৬৬ শতাংশ নম্বর পেয়েছে অ্যাথেনিয়াম ইনস্টিটিউশন স্কুলের ছাত্রটি। জীবনবিজ্ঞানে পেয়েছে ৮১। মার্কশিট পেয়ে মাকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে নুরউদ্দিন। আনন্দে তখন কাঁদছে খালপাড়ের গোটা বস্তিই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy