বড়দিন উপলক্ষে সাজ। শিয়ালদহের একটি বাঙালি খ্রিস্টান পরিবারে। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র
তাঁর ছেলেমেয়ের বিয়েতেও গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে পাদ্রী মশাই এসেছিলেন যথা সময়ে। কনের বাড়ির হলুদের বাটি হাতে বিশেষ প্রার্থনার ‘সার্ভিসে’র পরেই তা বরের বাড়ি পৌঁছে যাবে। আর বিয়েয় অবধারিত ‘ওয়েডিং রিং’ দিয়ে সিঁদুরদান পর্ব।
বৌমানুষের সিঁদুর, শাঁখা, লোহা পরার রীতিও ‘বাঙালি খেশ্চান ঘরের’ পরম্পরা বলেই ধরেন একদা দমদমের ক্রাইস্টচার্চ স্কুলের ইতিহাস শিক্ষিকা তৃপ্তি সরকার। নানা কারণে এখন কিছুটা সিঁদুরবিমুখ বাঙালি মেয়েরা। গির্জায় একেলে মেয়ে, বৌদের দেখে তৃপ্তির মনে আসে নানা পুরনো কথা। দমদমে সেন্ট স্টিফেন্স গির্জায় যাওয়া হবে না এই করোনাকালে। তবে মনটা পড়ে আছে, ছোটবেলার মানিকতলা বা বিয়ের পরে ব্যারাকপুর ডায়োসিসে উচ্ছল সেই বড়দিনে।
তৃপ্তিদেবীর স্বামী রীতেন্দ্রনাথ একটি প্রকাশনা সংস্থার আধিকারিক। অর্গ্যান বাজাতেন ব্যারাকপুরে মেথডিস্ট গির্জার সার্ভিসে। তাঁদের পুত্র রীতেশের ছেলেবেলা জুড়েও বড়দিন মানে, খোল-করতাল, হারমোনিয়ম বাজিয়ে সান্তাবুড়ো থেকে রংচঙে বিচিত্র সাজে কীর্তনের শোভাযাত্রা। ক্রিসমাস ইভ বা তার আগের সন্ধ্যার এই গানই বড়দিনের আগমনি। ব্যারাকপুর, দমদম থেকে আসানসোল-দুর্গাপুর কিংবা তালতলা-এন্টালি থেকে রানাঘাট ক্রিশ্চান কলোনির বাতাসে সুর তোলে জিশু-দিনের অমোঘ হাতছানি।
অধুনা ঠাকুরপুকুরের বাসিন্দা, সেন্ট পলস মিশন স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত অ্যাকাউন্টস শিক্ষক জেভিয়ার জীবন রোজারিও গুনগুন করেন, আনন্দ আনন্দ আনন্দ করো ভাই, প্রভু জিশু এসেছেন ধরণীতলে / চলো তাঁকে গিয়ে প্রণাম জানাই! মনটা পড়ে থাকে ছেলেবেলার তালতলা বাজারে। বন্ধু লুইস দীপক রোজারিও, অ্যান্টনি মুকুল গোমস বা ম্যানুয়েল মিলন গোমসদের সঙ্গে রেণু আন্টি, ডরোথি কাকি, এডওয়ার্ড আঙ্কলদের বাড়ি গান শোনালে পকেট ভরে মিলবে পার্বণী। সেই সঙ্গে কেক, চানাচুর, রোজকুকি বা পাকন পিঠের আদর।
নিমকির স্বাদের সুদৃশ্য খাস্তা রোজকুকির চল হয়েছে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের দেখাদেখি। তবে ঢের পুরনো গুড়-নারকোলের পুর ঠাসা নৌকার আদলের পাকন পিঠের স্বাদ। বাঙালি খ্রিস্টান ঘরেও ঘটি-বাঙালের ফারাক টনটনে। ক্রিসমাসের দুপুরে ঘটিদের পোলাও আর খাসির মাংসই মনপসন্দ। শীতের পেঁযাজকলি, বেগুন, শিমের সঙ্গে পাঙাশ-বোয়ালের গরগরে ভাজা কারি ছাড়া ঢাকাইয়া জেভিয়ারবাবুর বড়দিন পানসে। পর্তুগিজদের হাতে দীক্ষিত প্রধানত রোম্যান ক্যাথলিক এই বাঙালদের আবার শেফ হিসেবে নামডাক দেশেবিদেশে। ভিনিগারে মজানো মাংস বা ইলিশের ভিন্দালু রান্নায় গোয়ান, অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের মতো এই বাঙালি খ্রিস্টানদেরও নিজস্ব ঘরানার স্বাক্ষর।
বাড়ির সবাই মিলে আগেভাগে মোরব্বা কুচিয়ে পারিবারিক কেকটা এখনও পাড়ার বেকারি থেকে ‘জ্বালাই’ করে আনাই দস্তুর বাঙালি খ্রিস্টানদের সাবেক মহল্লায়। কখন কার কেক উনুনে ঢুকবে তা চিরকুটে আগাম লিখিয়ে আনতে হয়। তবে বড়দিনের নতুন গুড়ের পায়েসটায় একান্তই গিন্নিদের হাত যশ।
কলকাতা ডায়োসিসের অর্থ সচিব রীতেশ সরকার ও তাঁর স্ত্রী সেন্ট পলস মিশনের অধ্যক্ষা সঞ্চিতা বিশ্বাসদের বড় হওয়ার অনুষঙ্গে এখানকার মূল স্রোত সংস্কৃতিরই প্রভাব। রীতেশ ও তাঁর বোন রঞ্জনা ছোটবেলায় লক্ষ্মীপুজোয় আলপনা দিয়েছেন। পারতপক্ষে ধানদুব্বো দিয়ে ভাইফোঁটার মজাটুকু হাতছাড়া করেন না। রীতেশ বলছিলেন, “পুজোয় ঠাকুর দেখা এবং নিউ মার্কেটে বাজার করে ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর আনন্দ আমাদের কাছে বরাবরই সমান।” পিঠেপায়েসের স্বাদে সংস্কৃতির মিশেলের ছোঁয়াচটুকু বাঙালির বড়দিনেরও সৌরভ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy