Advertisement
২৪ ডিসেম্বর ২০২৪
টাকা দাও, চাকরি নাও। শিক্ষায় নিয়োগের দর কত? শর্তই বা কী?
West Bengal SSC Scam

SSC Scam: প্রাথমিকে ১০-১২ লক্ষ, দ্বাদশে কুড়ির টোপ

চাকরিপ্রার্থীদের মতে, যে ভাবে জেলায় জেলায় চাকরি বিক্রির জাল ছড়িয়েছিল, তাতে কয়েক হাজার মানুষ সেই ফাঁদে পা দিয়েছিলেন।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

আর্যভট্ট খান
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২২ ০৬:২৯
Share: Save:

ফেসবুকে নতুন চাকরির স্টেটাস দিতে গিয়েই বাধল গোল! ‘জয়েনিং অ্যাজ় অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার’।

পরিচিতের ওই ফেসবুক স্টেটাস দেখেই খটকা লেগেছিল ওয়েটিং লিস্টে ২৫৯ র‌্যাঙ্কে থাকা নবম-দশমের এক চাকরিপ্রার্থীর। তিনি জানান, ওয়েটিং লিস্টে পরিচিতের নাম তো ছিল ২৭৫ নম্বরে! তা হলে চাকরি হল কী করে? তাঁর কথায়, ‘‘নবম-দশমের অঙ্কের অষ্টম কাউন্সেলিং পর্যন্ত ওবিসি মেল-ফিমেল ক্যাটেগরিতে ২০২ পর্যন্ত র‌্যাঙ্কের প্রার্থী ডাক পেয়েছিলেন। তা হলে ২৭৫ র‌্যাঙ্কের প্রার্থী স্কুলে যোগ দিলেন কী করে? তা জানতে আরটিআই করে ওই প্রার্থীর স্কুলে যোগদানের সব নথি জোগাড় করে মামলা করি। আমার মামলার জেরে ওই প্রার্থীর স্কুলে চাকরি বাতিল হয়।”

ধর্মতলায় গান্ধী-মূর্তির কাছে নবম-দ্বাদশের বিক্ষোভ মঞ্চে বসে ওই চাকরিপ্রার্থীর দাবি, “আমার নীচের র‌্যাঙ্কের থাকা ওই প্রার্থীর চাকরি যে টাকার বিনিময়ে হয়েছিল, সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সেই নিয়ে বার বার বলেওছি। এখন প্রায় ২২ কোটি টাকা উদ্ধারের পরে বোঝাই যাচ্ছে যে আমাদের দাবিই ঠিক। টাকা নিয়েই এই রকম বহু প্রার্থীরই র‌্যাঙ্ক উপরে তোলা হয়েছিল।”

চাকরিপ্রার্থীদের আরও দাবি, টাকার পাশাপাশি এসএসসি-র যে সব নথি উদ্ধার হয়েছে, খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে, চাকরির জন্য যাঁরা টাকা দিয়েছিলেন, সেগুলো তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা সংক্রান্ত নথি। কারণ, যারা টাকার বিনিময়ে চাকরি দিত, চাকরিপ্রার্থী পুরো টাকা না মেটানো পর্যন্ত নথি তারা নিজেদের কাছে রেখে দিত। প্রতিবাদ-মঞ্চে বসা এক চাকরিপ্রার্থীর কথায়, ‘‘অনেকটা সুদের কারবারির মতোই ওদের কাজ-কারবার। পুরো টাকা দাও, অরিজিনাল নথি আর চাকরি নিয়ে যাও। জেলায় জেলায় স্থানীয় দালালরা ছড়িয়ে রয়েছে। তারাই চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে টোপ দেয়।’’ এ প্রসঙ্গেই উঠছে ‘সৎ রঞ্জন’-এর কাহিনি। বাগদার বাসিন্দা রঞ্জন ওরফে চন্দন মণ্ডল টাকার বিনিময়ে চাকরি দিয়েছেন আবার চাকরি দিতে না পারলে টাকাও ফেরত দিয়েছেন বলে স্থানীয় বাসিন্দারাই জানিয়েছেন।

নবম থেকে দশমের এক চাকরিপ্রার্থী বলেন, “আমার কাছেই ১৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে চাকরির প্রস্তাব এসেছিল। প্রথমে পাঁচ লক্ষ

আগাম। সেই সঙ্গে আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা-সহ কিছু নথি ওরা রেখে দেবে। তার পর ধাপে ধাপে টাকা দিতে হবে। পুরো টাকা জমা দিলে নথি ফেরত পাব। সেই সঙ্গে চাকরির নিয়োগপত্রও।” ওই চাকরিপ্রার্থী জানান, তিনি সেই প্রস্তাবে রাজি হননি। চাকরিপ্রার্থীদের একাংশের দাবি, চাকরির টোপ থেকেই তাঁরা জানতে পেরেছিলেন কোন চাকরি কত টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাঁদের অভিযোগ, স্কুলের গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি ১০ লক্ষ, প্রাথমিক স্কুলে ১০-১২ লক্ষ, স্কুলের নবম থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষকতার জন্য ১৫-১৮ লক্ষ এবং একাদশ-দ্বাদশের জন্য ১৮-২০ লক্ষে রফা হয়েছে বেশির ভাগ জায়গাতেই। আর সেই অঙ্ক থেকেই তাঁদের দাবি, সর্বনিম্ন ১০ লক্ষ করে যদি মাথাপিছু ধরা যায়, অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া ২১ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা অন্তত ২২০ জনের চাকরিপ্রার্থীর টাকা। চাকরিপ্রার্থীদের মতে, যে ভাবে জেলায় জেলায় চাকরি বিক্রির জাল ছড়িয়েছিল, তাতে কয়েক হাজার মানুষ সেই ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। তা হলে হিসাবটা কী?

আন্দোলনকারী এক চাকরিপ্রার্থীর হিসাব, “গ্রুপ ডি-তে ৬০৯ জন, গ্রুপ সি-তে ৩৮১ জন এবং প্রাথমিকের ২৬৯ জন— মোট ১২৫৯ জনের চাকরি অনিয়মের অভিযোগে বাতিল করেছে আদালত। এই ১২৫৯ জন যদি ১০ লক্ষ টাকা করেও চাকরির জন্য দিয়ে থাকেন, তা হলে অঙ্কটা ১২৫ কোটির কিছু বেশি।” চাকরিপ্রার্থী ইলিয়াস বিশ্বাসের দাবি, ১২৫৯ জনের টাকা ১০ লক্ষ করে হিসাব করলে ১২৫ কোটি হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এটা আরও বেশি হওয়ার কথা। কারণ, প্রাথমিকের চাকরিপ্রার্থীরা ১০ লক্ষের বেশি দিয়েছে। ইডি সূত্রেরও দাবি, শিক্ষায় নিয়োগে কেলেঙ্কারির অর্থমূল্য অন্তত ১২৫ কোটি টাকা।

উচ্চ প্রাথমিকের এক চাকরিপ্রার্থী তথা পশ্চিমবঙ্গ আপার প্রাইমারি চাকরিপ্রার্থী মঞ্চের সহ-সভাপতি সুশান্ত ঘোষ আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, মামলার জটে গত আট বছর ধরে তাঁদের নিয়োগই হয়নি। কিন্তু নিয়োগ হওয়ার আগেই টাকার বিনিময়ে চাকরি পেতে গিয়ে খেসারত দিয়েছেন অনেকে। সুশান্ত বলেন, “২০২০ সালের ১১ ডিসেম্বর ১৪,৩৩৯টি শূন্যপদের পুরো মেধা তালিকাই অনিয়মের কারণে বাতিল করে দেয় হাই কোর্ট। কারণ, ওই তালিকায় প্রশিক্ষণ পাননি এমন লোকেরা ছিলেন।” সুশান্ত জানান, মেধা তালিকায় অনিয়মের ব্যাপ্তি এতটাই ছিল, যে ২০৩৪টি মামলা দায়ের হয়েছিল। প্রায় ২১ মাস ধরে ৫২ টি শুনানির পরে ওই মেধা তালিকা বাতিল হয়।

সুশান্তদের দাবি, ওই তালিকা বাতিল হয়ে যাওয়ায় বহু চাকরিপ্রার্থী বিপাকে পড়েন। কারণ, তাঁরা টাকা দিলেও চাকরি পেলেন না। দালালদের কাছে তখন তাঁরা টাকা ফেরত চান এবং ব্যর্থ হন। সুশান্তের কথায়, ‘‘সেই টাকার হিসাব কোথায়? সব মিলিয়ে বাতিল হওয়া চাকরির দাম কয়েকশো কোটি টাকার কম নয়।’’

এখন প্রশ্ন হল, টাকাটা কোন পথে কোথায় গেল?
(চলবে)

অন্য বিষয়গুলি:

West Bengal SSC Scam TET Scam
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy