গত কয়েকদিন বিভিন্ন প্রসঙ্গে শাসকের প্রতি সুকান্তর আক্রমণের ভাষায় ঝাঁজের মাত্রা বাড়তে দেখা যাচ্ছে। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ
মিনমিনে গলা। শব্দ খুঁজতে সময় লাগে। সুকান্ত মজুমদার বিজেপির রাজ্য সভাপতি হওয়ার পরে তাঁর দলের মধ্যেই অনেকে আড়ালে-আবডালে এমন মন্তব্য করেছিলেন। তাঁরা কি খেয়াল করেছেন, ইদানিং সুকান্তের কথায় ঝাঁজ বাড়ছে? পূর্বসূরী দিলীপ ঘোষের মতো অতটা ঠোঁটকাটা না হলেও ‘আক্রমণাত্মক’ তো হচ্ছেনই সুকান্ত। যার সর্বশেষ উদাহরণ বুধবারের সুকান্ত-বাণী। পুরুলিয়ায় দলের সমাবেশে বিজেপির রাজ্য সভাপতি বলেছেন, ‘‘তৃণমূলের পাশে পুলিশ না থাকলে ১৫ মিনিটে ওদের ঘরে ঢুকিয়ে দেব!’’
এমন হুঙ্কার বাংলার পরিচিত। এমন হুঙ্কারের মালিকও বাঙালির কাছে পরিচিত— দিলীপ ঘোষ। সেই মেজাজই ধরা পড়ছে সুকান্তের কথায়। প্রতিক্রিয়ায়। গত কয়েকদিন বিভিন্ন প্রসঙ্গে শাসকের প্রতি সুকান্তর আক্রমণের ভাষায় ঝাঁজের মাত্রা বাড়তে দেখা যাচ্ছে। সে সাংবাদিক বৈঠক হোক বা দলের সাংগঠনিক বৈঠক। সুকান্ত সম্প্রতি দিলীপকেও যে ভাবে জবাব দিয়েছেন, তা-ও প্রণিধানযোগ্য। তাতেই পদ্মশিবিরের অন্দরেও প্রশ্ন উঠেছে, বটানি স্যরের গলায় কি রাজনীতির তাপ? ঘটনাচক্রে, বৃহস্পতিবারেই হুগলির চুঁচুড়ায় একই সঙ্গে মিছিলে হাঁটছেন সুকান্ত-দিলীপ। তার আগে দু’জনের সঙ্গেই যোগাযোগ করেছিল আনন্দবাজার অনলাইন। সুকান্ত মানতে নারাজ, যে তিনি দিলীপকে অনুসরণ করছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমি তো কোনও খারাপ কথা বলিনি। কাউকে অনুসরণও করিনি। যেটা বাস্তব, সেটাই বলেছি। পুরুলিয়ায় পুলিশ যে নিরপেক্ষ নয়, সেটা তো প্রমাণিত সত্য! তাই সেখানে গিয়ে আমি বলেছি, পুলিশ পাশে না থাকলে তৃণমূলকে ঘরে ঢুকিয়ে দেব। মেরে-ধরে ঢোকাব এমনটাও বলিনি। রাজনৈতিক ভাবেই মোকাবিলা করব। এখনও বলছি, পুলিশ সঙ্গে না থাকলে তৃণমূল আমাদের সঙ্গে পেরে উঠবে না।’’ আর দিলীপ? তাঁর জবাব, ‘‘অনুকরণ বা অনুরসণের বিষয় নেই। কর্মীরা যখন মার খায়, তখন রাজ্য সভাপতিকে এই ভাবেই কথা বলতে হয়! আর এই ভাষাটাই তৃণমূল বোঝে। সেই কারণেই আমার কথায় কর্মীরা সমর্থন করেছেন। রাস্তায় নেমেছেন।’’
ছোটবেলা থেকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) সঙ্গে যুক্ত হলেও সুকান্তের ‘রাজনৈতিক বয়স’ খুব বেশি নয়। লেখাপড়া ও গবেষণা শেষ করে ‘ডক্টর’ সুকান্ত গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতে করতেই ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হন। প্রথম বারেই জয়। তবে নিজের কেন্দ্র বালুরঘাটের বাইরে রাজনীতিক হিসাবে তেমন পরিচয় ছিল না। যদিও অনেক আগে থেকেই আরএসএস এবং বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নজর ছিল তাঁর উপর। নবান্ন দখল হোক বা না হোক, দলের রাশ ধরতে দিলীপের পরে সুকান্তকে যে বাছা হবে, সেটা নাকি আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। ঘোষণা হয় ২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। রাজ্য বিজেপির তখন বিপর্যস্ত অবস্থা। বিধানসভা নির্বাচনে আশানুরূপ ফল না হওয়ায় নেতা থেকে কর্মী— সকলের মনোবল তলানিতে। রাজনৈতিক সংঘাতও চলছিল রাজ্যের নানা জায়গায়। অথচ কর্মীদের পাশে নেতারা নেই! ভোটের আগে যাঁরা বিজেপিতে নাম লিখিয়েছিলেন তাঁরা একে একে ফিরছেন তৃণমূলে। যাঁরা ফিরতে পারছেন না, তাঁরা নাগাড়ে দলবিরোধী কথা বলে চলেছেন। এর পরেই বাবুল সুপ্রিয়র বিজেপি-ত্যাগ। তার আগে-পরে বাবুল-দিলীপ প্রকাশ্য তরজা। এমনই এক পরিস্থিতিতে বালুরঘাটের বুবুনের (সুকান্তর ডাকনাম) হাতে আসে রাজ্য দলের দায়িত্ব।
প্রধান বিরোধী দলের প্রধান নেতা হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কারও কথায় কান না দিলেও রাজ্যে অনেক নেতাই আড়ালে বলতে শুরু করেন, ‘‘বলদ দিয়ে যেমন হালচাষ করা যায় না, তেমনই অধ্যাপক দিয়ে মাঠ-ময়দানের রাজনীতি হয় না। দলকে টেনে তুলতে লড়াকু নেতা দরকার।’’ ফলে দলের মধ্যেও লড়াই ছিল সুকান্তের। সে লড়াই এখনও রয়েছে। ক’দিন আগেই যেমন দিলীপ মন্তব্য করে বসলেন, ‘‘সুকান্তর অভিজ্ঞতা কম।’’ প্রথমে মনে হয়েছিল ‘গুরুজনের উপদেশ’ মনে করে সেটা হজম করে নেবেন সুকান্ত। কিন্তু তিনি দিলীপকে জবাব দিলেন দিলীপের এলাকায়, দিলীপকে পাশে নিয়েই। দিলীপের লোকসভা কেন্দ্র মেদিনীপুরে বৈঠকে গিয়ে সটান বললেন, ‘‘শুরুতেই কারও অভিজ্ঞতা থাকে না। আমি যখন রাজ্য সভাপতি হয়েছি, তখন আড়াই বছর সাংসদ থাকার অভিজ্ঞতা ছিল। আর দিলীপ ঘোষ যখন সভাপতি হন, তখন ছ’মাস, এক বছরের অভিজ্ঞতা ছিল।’’ যা শুনে বিজেপি নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, ইনি আগের ‘সুকান্তদা’ নন।
তবে দিলীপ সম্পর্কে ভুল তথ্য দেননি সুকান্ত। সঙ্ঘ প্রচারক দিলীপ বিজেপিতে যোগ দেওয়ার মাস ছয়েকের মধ্যেই রাজ্য সভাপতি হয়ে যান। এর পর বিধায়ক হন, সাংসদ হন। দিলীপের আমলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ‘উত্থান’ নিয়ে যাঁরা বড়াই করেন, তাঁরা সুকান্তর অভিষেকের পথ মসৃণ করে দেননি। নতুন রাজ্য কমিটি থেকে জেলা, মণ্ডলের দায়িত্ব বণ্টন নিয়ে এখনও চলছে বিক্ষোভ। সরাসরি রাজ্য নেতৃত্বকে দোষারোপ চলছে। হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপ এবং পদ ছাড়ার হিড়িক পড়েছে। ফেসবুকেও বিপ্লব চলছে। প্রথম দিকে এ সবের জবাবে সংবাদমাধ্যমকে অধ্যাপক সুকান্ত শান্ত গলায় বলতেন, ‘‘আমাদের দলে মতান্তর থাকলেও মনান্তর নেই।’’ সম্প্রতি সপাটে বলেছেন, ‘‘দলের শৃঙ্খলা সবচেয়ে আগে। দলের রীতি, নিয়ম মেনেই সকলকে চলতে হবে।’’
শাসককে আক্রমণ করার ক্ষেত্রেও বদলাচ্ছে সুকান্তের সুর ও স্বর। যুবমোর্চার বিকাশ ভবন অভিযানে পুলিশের জলকামানের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন। পরে বলেছেন, ‘‘পুলিশ ভয় পাচ্ছে। বাম-কংগ্রেস মিছিল করলে তাদের থামানো হয় না। বিজেপি আন্দোলন করলে থামানো হয়। এটাই প্রমাণ করছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিকে ভয় পান।’’ স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ নিয়েও তিনি চাঁছাছোলা— ‘‘আমরা জানি, তৃণমূল নেতারা অনেকেই পছন্দের চারকিপ্রার্থীদের তালিকা বানিয়ে পাঠিয়েছেন শিক্ষা দফতরের কাছে। শুধু পার্থ চট্টোপাধ্যায় নন, নবান্নের ১৪ তলায় একজনের কম্পিউটারেও সেই লিস্ট টাইপ হয়েছে। ১৪ তলা অবধি পৌঁছবে এসএসসির তার। তাই পুলিশ এত আতঙ্কিত, তৃণমূল এত আতঙ্কিত।’’ তার পরেই বুধবার পুরুলিয়ার হুঙ্কার। ‘ঢুকিয়ে দেব’, ‘পুঁতে দেব’ মার্কা যে হুঙ্কার দিলীপের মুখে শুনতে অভ্যস্ত বাংলা। ‘পরিবর্তিত’ সুকান্তও কি সেই পথেই হাঁটবেন?
বিজেপি শিবিরের অনেকের দাবি, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। তবে সুকান্ত জানেন, কখনও-সখনও ‘দিলীপ-বাণী’ প্রয়োজন। দিন দিন তিনি জনসভার বক্তৃতায় কর্মীদের চাঙ্গা করার ভাষা আয়ত্ত করছেন। কিন্তু তাতে দিলীপের ছায়া রয়েছে বলে মানতে নারাজ সুকান্ত-ঘনিষ্ঠেরা। তাঁদের বক্তব্য, সব বিষয়ে মতামত জানানোয় মত নেই সুকান্তের। কোন বল ছাড়তে হবে, সেটা যেমন জানেন তিনি, তেমনই কখন বাইরের বল পা বাড়িয়ে খেলতে হয়, জানেন তা-ও। হতে পারে। না-ও পারে। কিন্তু দিলীপের সঙ্গে সুকান্তের তুলনা শুনে খানিক ক্ষুব্ধ বর্তমান রাজ্য সভাপতির ঘনিষ্ঠরা। তাঁরা বলছেন, ‘‘আর যা-ই হোক, সুকান্তদা কখনও গরুর দুধে সোনা খুঁজতে যাবেন না!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy