পশ্চিমবাংলায় ভোট ‘হয়’ না। ভোট ‘করানো’ হয়। যুগ যুগ ধরে তা হয়ে আসছে। প্রায় সব দলেরই পরিচিত লব্জ হল, বুথে ভোট ‘করানোটাই’ আসল কাজ। গত কয়েক বছর ধরে আরও একটি কথা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের মুখে মুখে ঘোরে— ভোট হল টি২০ ক্রিকেট। ম্যাচের দিন যে যেমন খেলবে, তেমন ফল হবে। তার আগে কে নেটে কত ভাল অনুশীলন করেছে, তাতে কিছু যায়-আসে না। সেই সূত্রেই ২০২৬ সালের ভোটের এক বছর আগেই পুরনো প্রশ্ন নতুন করে উঠছে— শাসকদল তৃণমূলকে টেক্কা দেওয়ার মতো বুথভিত্তিক সংগঠন কি রাজ্যে কোনও বিরোধী দলের আছে?
ভোটের লক্ষ্যে তৃণমূল আপাতত ‘বাংলার ভোটরক্ষা’ নামক কর্মসূচি শুরু করেছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে যে কর্মসূচির নান্দীমুখ করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর দলের ৪,৫০০ নেতাকে নিয়ে ‘ভার্চুয়াল’ বৈঠক করে কর্মসূচিকে ‘পেশাদার’ সাংগঠনিক ছাঁচে ফেলেছেন দলের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আপাতত জেলায় জেলায় প্রশিক্ষণ শিবির শুরু হয়েছে। যাতে সক্রিয় সহযোগিতা করছে পেশাদার সংস্থা আইপ্যাক। সেই কর্মসূচিতে ২০২১ সালের ভোটের কয়েক মাস আগে তৈরি হওয়া ‘দিদির দূত’ অ্যাপকে নতুন মোড়ক দিয়েছে তৃণমূল। ভোটার তালিকা সংশোধনের বিষয়ে যাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য যাচাই করতে যাবেন, তাঁরা ওই অ্যাপের মাধ্যমেই বুথভিত্তিক পরিসংখ্যান দেবেন দলকে। গুগ্ল প্লে স্টোরের পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় ১১ লক্ষ ‘ডিভাইসে’ (মোবাইল অথবা ট্যাব) ওই অ্যাপ ইতিমধ্যেই ডাউনলোড হয়ে রয়েছে। যে সংখ্যা সাংগঠনিক শক্তি বিচারে ‘তাৎপর্যপূর্ণ সূচক’ বলেই অভিমত রাজনৈতিক মহলের অনেকের।
তৃণমূলের সাংগঠনিক অ্যাপ যে তৃণমূলের লোকেরাই বেশি ‘ডাউনলোড’ করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তবে শাসকদল সম্পর্কে বিরোধী দল এবং সাধারণ মানুষেরও আগ্রহ থাকে। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায়, তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী নন, এমন অনেকে ওই অ্যাপ শুধুমাত্র কৌতূহলবশত ‘ডাউনলোড’ করে নিজেদের কাছে রেখেছেন, তা হলেও সেই সংখ্যা যে বিপুল নয়, তা অনুমেয়। তৃণমূল নন, এমন এক লক্ষ মানুষও ওই অ্যাপ নিজের ডিভাইসে রাখেন, তা হলেও হিসাব বলছে কমবেশি ১০ লক্ষ সক্রিয় তৃণমূলকর্মী রয়েছেন। যাঁদের কাজের মূল পরিধি বুথস্তর। এখানে আরও একটি প্রশ্ন জাগতে পারে। ২০২১ সালে যাঁরা ওই অ্যাপ ‘ডাউনলোড’ করেছিলেন, তাঁদের সকলেই যে এখনও শাসকদলের সক্রিয় কর্মী রয়েছেন, তার কী মানে আছে? আনুষ্ঠানিক ভাবে না হলেও তৃণমূলের ‘ভোটরক্ষা’ কর্মকাণ্ডে যুক্ত এক নেতা একান্ত আলোচনায় মানছেন, পুরনোদের সকলে যেমন সক্রিয় নেই, তেমনই আবার নতুন অনেক সক্রিয় কর্মী দলীয় কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
বাংলায় কমবেশি ৮০ হাজার বুথ রয়েছে। হিসাব কষলে দেখা যাচ্ছে, যতই কম হোক, গড়ে বুথ পিছু তৃণমূলের ১০ জন লোক রয়েছেন। বুথভিত্তিক যে শক্তি তৃণমূলের রয়েছে, তা কি বিরোধী আর কোনও দলের রয়েছে? একান্ত আলোচনায় বুথস্তরে সাংগঠনিক ফাঁকের কথা মানছেন সব বিরোধী দলের নেতারাই। ২০২৬ সালের লোকসভা ভোটের আগে যা শাসকদলের নেতাদের ঠোঁটে মুচকি হাসি এনে দিচ্ছে। রাজ্যের মন্ত্রী তথা মহিলা তৃণমূলের সভানেত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য যেমন স্পষ্টই বলছেন, ‘‘বিরোধীদের আস্ফালন শুধু সংবাদমাধ্যম আর সমাজমাধ্যমে। তারা যা বলে, সবটাই বলার জন্য বলে। আমাদের মতো অন্য কোনও দলের এই কর্মীবাহিনী নেই।’’ রাজ্যসভার বিজেপি সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য অবশ্য পাল্টা বলছেন, ‘‘যারা এটা ভেবে আনন্দ পাচ্ছে পাক। কয়েকটা মাস গেলেই বুঝতে পারবে। বুথে তিনটে করে এজেন্ট বসলেও তৃণমূলের বিসর্জন নিশ্চিত।’’
এ কথা ঠিক যে উত্তরবঙ্গ, রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল, অবাঙালি অধ্যুষিত কিছু এলাকা এবং মতুয়াভূমে বিজেপির বুথস্তরের সাংগঠনিক শক্তি ভাল। কিন্তু সেখানে তৃণমূলের শক্তিও যে একেবারে নেই, তা নয়। অর্থাৎ, সেই অর্থে বিজেপির জন্য ‘ফাঁকা মাঠ’ নেই। কিন্তু বহুলাংশে তৃণমূলের কাছে মাঠ ফাঁকা থেকে যাওয়ার অবকাশ রয়েছে। যা অতীতেও দেখা গিয়েছে। তবে এ-ও বাস্তব যে, সব সময় সাংগঠনিক বা বুথের শক্তিই শেষ কথা বলে না। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা তীব্র হলে বুথস্তরের শক্তির সমীকরণ কাজ করে না। যেমনটা করেনি ২০০৯ সালের লোকসভা এবং ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে সিপিএমের ক্ষেত্রে। বুথের সংগঠনে একটা সময়ে সিপিএম ছিল সব থেকে আগুয়ান। প্রয়াত রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস খানিক শ্লাঘা নিয়েই একবার বলেছিলেন, ‘‘পাড়ায় কোন বাড়িতে নিরামিষ রান্না হচ্ছে, আর কোন বাড়িতে কচি পাঁঠার ঝোল, তা আমাদের শাখা সম্পাদকেরা জানেন।’’ অর্থাৎ, এলাকায় এলাকায় দলের নিচুতলার কর্মীদের কতটা নজরদারি এবং নিবিড় সংযোগ রয়েছে, অনিল সেটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা ধসে পড়েছিল। তার পর থেকে সিপিএম এখনও পর্যন্ত উঠে দাঁড়াতে পারেনি। সেই সূত্রেই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার বলেছেন, ‘‘সুনামি আসার আগে অনেক মেশিন অনেক তথ্য দিয়েছিল। কিন্তু সুনামি এসে সেই মেশিনকেও ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং রাজ্য পুলিশ— ভোটের দিন এই তিনটি ‘অ্যাপ’ ঠিক মতো কাজ করলেই তৃণমূলের অ্যাপের কাজ বন্ধ হয়ে যাবে।’’ আবার সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘অ্যাপের মাধ্যমে তৃণমূল এ সব করে একটা রাংতা দেখাতে চাইছে, কিন্তু এ ভাবে সংগঠন টিকিয়ে রাখতে পারবে না।’’
মুকুল রায় যখন তৃণমূলের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’, তখন তিনিই শাসকদলের ভোটের সংগঠন দেখতেন। সিপিএমের অনিলের পরে যে মুকুলের ভোট বিষয়ক বুৎপত্তি ছিল, তা মানেন অনেকেই। সেই মুকুল তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়ার পরে পুরনো দলের ছক বুঝে বিজেপির হয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে মৌলিক একটি দাবি জানিয়েছিলেন। তা হল, এজেন্ট বসার ক্ষেত্রে বুথ বা লাগোয়া বুথভিত্তিক সূচক উঠিয়ে বিধানসভা কেন্দ্রভিত্তিক অনুমতি দিক নির্বাচন কমিশন। অর্থাৎ, এক বিধানসভার ভোটার হলে তিনি সেই কেন্দ্রের যে কোনও বুথে এজেন্ট হতে পারেন। কারণ, একদা তৃণমূলের মুকুল বিজেপিকে বোঝাতে পেরেছিলেন, পদ্মশিবিরের শক্তি পুঞ্জীভূত নির্দিষ্ট এলাকায়। তা দিয়ে সব বুথে মুখোমুখি লড়াই সম্ভব নয়। ঘটনাচক্রে, নির্বাচন কমিশন সেই প্রস্তাব গ্রহণও করেছে। গত লোকসভায় সেই নিয়মেই এজেন্ট বসেছিল। কিন্তু তাতেও বিজেপি অধিকাংশ জায়গায় বুথ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেছে। কারণ, বুথস্তরে সারা বছরের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নেই।
বাংলার রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহালদের অনেকের বক্তব্য, ২০২১ সালে যে মেরুকরণের আবহে বিধানসভা ভোট হয়েছিল, তার কয়েক গুণ বেশি মেরুকরণের আবহে ২০২৬ সালের ভোট হবে। সেই আবহ ইতিমধ্যেই তৈরি হতে শুরু করেছে। কিন্তু তার পরেও আলোচনায় আসছে বুথভিত্তিক সংগঠন। আলোচনায় আসছে ভোট পরিচলানার ব্যবস্থায় রাজ্য সরকারি কর্মীদের ভূমিকা। যেখানে তৃণমূলের কার্যত ‘একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ’ রয়েছে। কারণ, দিনের শেষে ভোট হবে বুথে। আর পশ্চিমবঙ্গে ভোট ‘করাতে’ হয়।