এ ভাবেই গরুর গলায় কলার ভেলা লাগিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। ফাইল চিত্র।
সবই ‘উপরওয়ালার’ হাতে!
কেমন সে ‘উপরওয়ালা’? কখনও প্রবল বৃষ্টিকে বোঝাতে এই কথা বলে হাত উপরে তুলছেন তিনি। কখনও বা প্রশ্ন শুনে চুপ করে যাচ্ছেন সেই ‘হ্যান্ডলার’।
মালদহের একটা চালু কথা আছে: বর্ষায় ভাল বৃষ্টি হলে লাভ চাষিদের, আর পাচারকারীদের! মালদহের হবিবপুরে বইছে যে শ’দেড়েক মিটার চওড়া পুনর্ভবা নদী, তার ধারে চাষের জমির দিকে এমন ভাবে গরু নিয়ে যাওয়া হয়, যেন সেগুলিকে লাগানো হবে চাষের কাজে। এলাকাবাসীরা অবশ্য বলছেন অন্য কথা। তাঁদের দাবি, প্রবল বৃষ্টিতে বিএসএফের চোখে ধুলো দিয়ে ওই গরু নদীতে ভাসিয়ে দিতে পারলে ও-পারেই বাংলাদেশের পূর্ব দিনাজপুর জেলা, এক লপ্তে পার করা যায় দশ-বারোটা গরু। বিএসএফ এ কথা না মানলেও, হবিবপুর থেকে বৈষ্ণবনগর, পুরাতন মালদহ থেকে বামনগোলা, মালদহের সীমান্ত লাগোয়া গ্রামে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে পাচারের এই কৌশল।
মালদহের ১৭২ কিলোমিটারের মধ্যে এখনও ৩২ কিলোমিটার সীমান্ত উন্মুক্ত রয়েছে। এ ছাড়াও শ্মশানি, চরি অনন্তপুর, সবদলপুরে কাঁটাতারের বেড়া কেটেও গরু পাচারের অভিযোগ রয়েছে। সেই জন্য বৃষ্টির কথা বলে উপরে আঙুল দেখান ওই ‘হ্যান্ডলার’।
বিএসএফের মালদহ রেঞ্জের ডিআইজি সুধীর হুডার অবশ্য দাবি, “উন্মুক্ত সীমান্তে বাড়তি টহলদারি চালানো হয়। সীমান্তে জওয়ানেরা সব সময় সক্রিয় থাকেন। বর্ষার মরসুমে নদীপথে স্পিডবোটেও তল্লাশি চলে।”
এই সূত্রে ‘হ্যান্ডলার’দের কেউ কেউ জানান, পাচারের কারবারটা চলে তাঁদের অর্থাৎ ‘হ্যান্ডলার’দের সঙ্গে ‘চেনম্যান’ আর ‘কিংপিন’-দের দৌলতে। পুলিশ সূত্রে দাবি, ‘হ্যান্ডলার’রাই উত্তরপ্রদেশ, বিহার, হরিয়ানা থেকে গরু এনে সীমান্তে পৌঁছে দেয়। তাদের উপরে আছে ‘চেনম্যান’। তারা সীমান্ত লাগোয়া থানা, বিএসএফের একাংশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। সীমান্তে বিএসএফ বা পুলিশের হাতে উদ্ধার হওয়া গরুগুলি ডাকের মাধ্যমে অল্প দামে কিনেও নেয় ‘চেনম্যান’রা।
এক ‘হ্যান্ডলারে’র দাবি, ‘‘আমরা কথা বলি চেনম্যানদের সঙ্গে। তারা ম্যানেজার গোছের লোক। শুনেছি, চেনম্যানরা আবার রিপোর্ট করে কিংপিনকে। কিংপিনের দায়িত্ব রাজনীতি, পুলিশ, প্রশাসনের উপরের তলায় যোগাযোগ রাখা। তারা আমাদের নাগালের বাইরে।’’
এই দ্বিতীয় ‘উপরওয়ালা’ কারা? বিএসএফের তৎকালীন মালদহের ৩৬ নম্বর ব্যাটালিয়নের কমান্ডান্ট সতীশ কুমার গ্রেফতারের পরে, গরু পাচার সংক্রান্ত একাধিক তথ্য হাতে পান গোয়েন্দারা। গরু পাচার কাণ্ডে অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত এনামুল হকের দল ২০১৫-১৭ মালদহে সক্রিয় ভাবে কাজ করেছে বলে দাবি গোয়েন্দা সূত্রের। সেখানে ‘চেনম্যান’ হিসাবে ইংরেজবাজারের কমলাবাড়ি এলাকার এক জনের ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভূমিকা ছিল। কালিয়াচকে তৃণমূলের এক পঞ্চায়েত সদস্যের সঙ্গেও এনামুলের ‘দহরম মহরম’ ছিল বলে শোনা যায়। সে লোকটি আগে ছিল দিনমজুর। এলাকাবাসীর একাংশের দাবি, গরুর কারবারে নাম জড়ানোর পরে, তার ‘কাঁচা পয়সা’ বাড়ে। এনামুল ধরা পড়ার পরে এই ‘চেনম্যান’রা সতর্ক হয়ে গিয়েছে বলে শোনা যায়। তাই গরু পাচারের পরিমাণও কমেছে বলে দাবি।
যদিও দলের কারও এই কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূলের বর্তমান মালদহ জেলা নেতৃত্বের পাল্টা অভিযোগ, ২০১৫-১৭ সালে দলের তরফে জেলার দায়িত্বে থাকা এক নেতার সঙ্গে এনামুলের ‘ঘনিষ্ঠতা’ ছিল। তৃণমূলের জেলা সভাপতি আব্দুর রহিম বক্সীর কথায়, “গরু পাচার নিয়ে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা নিরপেক্ষ তদন্ত করলে, সেই নেতার নামও চর্চায় আসা উচিত।’’
এই ধরনের সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন বিজেপির দক্ষিণ মালদহের সভাপতি পার্থসারথি ঘোষ। তাঁর পাল্টা অভিযোগ, ‘‘রাজ্যের শাসক দলের যোগসাজশ ছাড়া, গরু পাচারের কারবার চালানো সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় সংস্থা নিজেদের সুবিধা মতো তদন্ত করবে। সে তদন্তে মালদহের তৃণমূলের অনেক নেতার নামই সামনে আসবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy