শনিবার এই বৈঠকেই তোপের মুখে পড়তে হয়েছে জেলা সভাপতিদের অধিকাংশকে। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া।
খাতায়-কলমে সব হিসেব ঠিকঠাক। সদস্য সংগ্রহ অভিযানে ‘স্বস্তিদায়ক’ অগ্রগতির ছবি। কিন্তু রাজ্য বিজেপির সেই আপাত স্বস্তির মাঝেও অস্বস্তির কাঁটা খচখচ করে উঠল শনিবার। ফের ‘ধমক’ জুটল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছ থেকে। তবে এ বার আর নিশানায় রাজ্য নেতৃত্ব নন। সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সুনীল বনসল এ বার কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন জেলা সভাপতিদের। দলের সক্রিয় কর্মীদের দূরে ঠেলে দিয়ে সর্বত্র ‘নিজেদের লোক’ ঢোকানোর অভিযোগ উঠল জেলা সভাপতিদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই। বনসলের সামনে পেশ হওয়া হিসেবেই তা স্পষ্ট হয়ে গেল। ফলে জেলা সভাপতিদের কথামতো আর কোনও মনোনীত কমিটি নয়, সাফ জানিয়ে দিলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।
সল্টলেকের এক অভিজাত হোটেলে শনিবার ‘বিশেষ সাংগঠনিক কর্মশালা’ ছিল বিজেপির। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক সুনীল বনসল দিল্লি থেকে এসেছিলেন সংগঠনের হালহকিকত বুঝে নিতে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) অমিতাভ চক্রবর্তী এবং অন্য সাধারণ সম্পাদকরা তো ছিলেনই। ছিলেন ‘সদস্যতা প্রমুখ’ শমীক ভট্টাচার্য-সহ সদস্য সংগ্রহ অভিযানে বিভিন্ন স্তরে কাজ করে আসা নেতা-নেত্রীরা।
এই বৈঠকেই জেলা সভাপতিদের একটা বড় অংশ সুনীল বনসলের ‘ভর্ৎসনার’ মুখে পড়েছেন বলে বিজেপি সূত্রের খবর। প্রাথমিক সদস্যপদের সংখ্যা ৪২ লক্ষ স্পর্শ করার পরেও কেন ‘ভর্ৎসনা’? কারণ প্রাথমিক সদস্যপদের পরের ধাপ যে ‘সক্রিয় সদস্যপদ’, তার তালিকায় গরমিলের চেষ্টার অভিযোগ। জেলায় জেলায় বা মণ্ডলে মণ্ডলে যাঁরা বিজেপির আসল সক্রিয় কর্মী, তাঁদের অনেককেই জেলা সভাপতিরা দূরে ঠেলে রাখতে চেয়েছেন, এমন ছবিই বনসলের নজরে ধরা পড়েছে বলে বিজেপি সূত্রের খবর। যদিও বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের তরফ থেকে কেউই এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। জবাব এড়িয়েছেন সদস্যতা প্রমুখ তথা সাংসদ শমীকও।
বিজেপি সূত্র জানাচ্ছে, কোন জেলা থেকে কারা ‘সক্রিয় সদস্য’ হতে পারেন, তার তালিকা আগেই চেয়ে নেওয়া হয়েছিল জেলাগুলির কাছ থেকে। সব জেলা থেকে আসা তালিকা একত্র করে ৭০ হাজারের মতো নাম পাওয়া গিয়েছিল বলে বিজেপি-র ওই সূত্রটির দাবি। শর্ত ছিল, এই প্রস্তাবিত ‘সক্রিয় সদস্য’দের প্রত্যেককে অন্তত ৫০টি করে নাম দলের প্রাথমিক সদস্য তালিকায় তুলতে হবে। শনিবারের বৈঠকে দেখা যায়, প্রস্তাবিত ৭০ হাজার জনের একটা বড় অংশ এই শর্ত পূর্ণ করতে পারেননি। যাঁরা পেরেছেন, তাঁদের সংখ্যা ৪০ হাজারের আশপাশে।
এ বারের সদস্য সংগ্রহ অভিযানে বিজেপির প্রাথমিক সদস্যের সংখ্যা বাংলায় অনেক বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু সক্রিয় সদস্যের সংখ্যা খুব বেশি হয়নি বলে বিজেপি সূত্রের খবর। বিভিন্ন এলাকায় অনেক নেতা ব্যক্তিগত চেষ্টায় ৫০-এর অনেক বেশি সংখ্যক প্রাথমিক সদস্য জোগাড় করেছেন। ফলে প্রাথমিক সদস্যের মোট সংখ্যাকে ৪২ লাখে পৌঁছে দেওয়া গিয়েছে। কিন্তু সক্রিয় সদস্য কমবেশি ৪০ হাজারে আটকে থেকেছে। বিজেপির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার দায়িত্ব সামলানো এক নেতার দাবি, ‘‘এই ৪০ হাজারের মধ্যে মাত্র হাজার দশেকের নাম জেলা থেকে পাঠানো প্রস্তাবিত সক্রিয় সদস্যদের নামের তালিকার সঙ্গে মিলেছে। বাকি ৩০ হাজার সক্রিয় সদস্যই জেলা সভাপতিদের দেওয়া তালিকার বাইরে থেকে উঠে এসেছেন।’’
সেখানেই গরমিলটা ধরেছেন সুনীল বনসল। জেলায় জেলায় বা মণ্ডলে মণ্ডলে যাঁরা দলের ‘আসল সম্পদ’, তাঁদের কি দূরে ঠেলে রাখার চেষ্টা হচ্ছিল? ‘নিষ্কর্মা’ লোকজনকে ‘সক্রিয় সদস্য’ হিসেবে দেখিয়ে সংগঠনকে কি জেলা সভাপতিরা কুক্ষিগত করার ছক কষেছিলেন? বনসল প্রায় এই রকম প্রশ্নের মুখেই জেলা সভাপতিদের শনিবার দাঁড় করিয়েছেন বলে বিজেপি সূত্রের দাবি।
যে নদিয়ায় এ বার বিজেপির সদস্য সংগ্রহ অভিযান সবচেয়ে বেশি সফল, সেই জেলারই এক প্রভাবশালী নেতার অভিযোগ, ‘‘সব স্তরে নিজেদের লোকজন বসিয়ে রেখে সংগঠনের রাশ নিজেদের হাতে রেখে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন কেউ কেউ। তাঁরা ভেবেছিলেন দল দখল করবেন। কিন্তু বিজেপিতে ওটা করা যায় না। বনসলজির বৈঠকেই সেটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।’’ যাঁরা জেলা সভাপতিদের পছন্দের লোক নন, তাঁরা ৫০-এর অনেক বেশি প্রাথমিক সদস্য করার পরেও সক্রিয় সদস্যপদের ফর্ম পাননি। এমন অভিযোগও তুলেছেন নদিয়ার ওই নেতা।
বিজেপি সূত্রের খবর, সল্টলেকে আয়োজিত বিশেষ সাংগঠনিক কর্মশালায় জেলা সভাপতিদের বনসল সাফ জানিয়েছেন যে, এই ছবি দেখার পরে আর কোনও মনোনীত কমিটি গঠনের চেষ্টাকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। মণ্ডল কমিটি হোক বা জেলা, সব স্তরেই এ বার নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি গড়ার পথে এগোবে দল।
এক জেলা সভাপতি আবার আগ বাড়িয়ে ‘ফার্স্ট বয়’ হতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন বলে বিজেপি সূত্রের খবর। তিনি শুধু জেলা সভাপতি নন, তিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও। সুনীল বনসলকে তিনি জানাতে যান যে, তিনি একাই পাঁচ হাজার সদস্য সংগ্রহ করেছেন। এ কথা জানানোয় প্রশংসা জুটবে বলে ওই জেলা সভাপতির আশা ছিল। কিন্তু বনসল তাঁকে নিরাশ করেন। বিজেপি সূত্রের খবর, বনসল তাঁকে বলেন যে, তিনি জেলা সভাপতির মতো নন, সাধারণ কর্মীর মতো কাজ করেছেন। পাঁচ হাজার প্রাথমিক সদস্যপদ নিজের নামের পাশে না লিখে, তা যদি তিনি অন্য কর্মীদের দিয়ে করিয়ে আনতে পারতেন, তা হলে তাঁর জেলায় সক্রিয় সদস্যের সংখ্যা আরও বাড়ত।
বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব অবশ্য গোটা বিষয় নিয়ে একেবারেই মুখ খুলতে চাইছেন না। প্রায় সবাই প্রকাশ্য মন্তব্য এড়িয়ে যাচ্ছেন। সক্রিয় সদস্যপদ নিয়ে বনসলের ‘ধমক’ নিয়ে প্রশ্ন করায় সদস্যতা প্রমুখ শমীক ভট্টাচার্যের জবাব, ‘‘আমার দায়িত্ব ছিল প্রাথমিক সদস্যপদ পর্যন্ত। সক্রিয় সদস্যপদ আমার দায়িত্ব নয়। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যেমন চান, সে ভাবেই নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি হবে।’’ কিন্তু নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি গড়তে হবে, এ কথা আলাদা করে কেন বলতে হল বনসলকে? বিজেপিতে তো মনোনীত কমিটিই সাধারণত হয়। শমীকের জবাব, ‘‘মনোনীত কমিটি হয় না। নির্বাচিতই হয়। কিন্তু নির্বাচনের দরকার হয় না। কারণ সর্বসম্মতিক্রমে সব কিছু হয়।’’ এ বার তা হলে সেই প্রক্রিয়া কেন চাইছেন না কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক? শমীকের জবাব, ‘‘বড় দল চালাতে গেলে বিচ্যুতি থাকতে পারে। কিন্তু এটা দলের সার্বিক চিত্র নয়। আমরা সবাই সংঘবদ্ধ ভাবে ২০২৬ সালে তৃণমূলকে হারিয়ে দেব, যদি তত দিন তৃণমূল থাকে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy