অভাব থাকলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়। আর পমফ্রেট মাছের জোগান যখন কম, দাম যখন আকাশছোঁয়া, বিকল্প হিসেবে ভাবতে হয় সিলভার পমপ্যানোর কথা।
সিলভার পমপ্যানো। পমফ্রেট আর এই মাছের গোত্র এক, কেবল প্রজাতি আলাদা। পমফ্রেটের তুলনায় একটু লম্বাটে। চামড়া একটু মোটা। তাজা পমফ্রেটের দেহে থাকে নীলাভ আভা, সিলভার পমপ্যানো সেখানে রুপোলি, চকচকে। কাঁটাও পমপ্রেটের চেয়ে মোটা। কিন্তু স্বাদ? রাজ্য মৎস্য উন্নয়ন নিগমের কর্তারা বলছেন, দু’ধরনের মাছেরই স্বাদ, গন্ধ একেবারে এক। পেঁয়াজ-টোম্যাটো দিয়ে পমফ্রেট মসালা, ফ্রাই কিংবা তন্দুরি বা সর্ষে বাটা দিয়ে রেঁধে খেতে দিলে পমপ্যানো-পমফ্রেটে তফাৎ করা মুশকিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, পমপ্যানোতে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, প্রোটিন, খনিজ পদার্থ আছে প্রচুর পরিমাণে। ঠিক যেমনটি থাকে পমফ্রেটে।
কিন্তু সামুদ্রিক মাছ পমফ্রেটের জোগানের ব্যাপারে পুরোটাই নির্ভর করতে হয় সমুদ্রের উপর। অর্থাৎ সমুদ্রে যেমন পাওয়া যাবে, তেমনই পমফ্রেট মিলবে। সমুদ্রের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। কৃত্রিম ভাবে পমফ্রেট চাষ সম্ভব নয়।
আর এখানেই পমপ্যানোর ইউএসপি। পমপ্যানো সামুদ্রিক মাছ হলেও ওই মাছের চাষ সম্ভব। অর্থাৎ জোগানের ক্ষেত্রে শুধু সমুদ্রের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার দরকার নেই।
সেই জন্যই পশ্চিমবঙ্গ মৎস্য উন্নয়ন নিগম হই হই করে সিলভার পমপ্যানোর চাষ শুরু করে দিয়েছে। পরীক্ষামূলক চাষ শুরু হয়েছিল গত বছর। তাতে সাফল্য মেলার পরেই পুরোদস্তুর এই চাষ করা হচ্ছে। এই মাছের চাষে এ বার রাজ্যের মৎস্যজীবীদের উৎসাহ দিতে নিগম বিভিন্ন পদক্ষেপ করছে। ইতিমধ্যেই এই মাছ চাষে উৎসাহ দেখিয়েছেন কয়েক হাজার মৎস্যজীবী। একটা সময়ে তেলাপিয়ার বিকল্প হিসেবে নাইলনটিকা মাছ চাষে উদ্যোগী হয়েছিল রাজ্য এবং তাতে সাফল্যও মিলেছিল। এখনও নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের একাংশের কাছে মাছ বলতে নাইলনটিকা। তার তুলনায় তেলাপিয়ার জোগান অনেকটাই কম।
পমপ্যানোর ক্ষেত্রে পমফ্রেটের চড়া দাম, চাহিদা অনুযায়ী জোগানের অভাবই তার বিকল্প মাছের সন্ধান করতে বাধ্য করেছে মৎস্য দফতরকে।
পাইকারি বাজারে পমফ্রেটের দাম সাড়ে চারশো টাকা র খুচরো বাজারে সেটা গিয়ে দাঁড়ায় সাড়ে পাঁচশো থেকে ছ’শো টাকা, এমনকী কখনও কখনও সাতশো টাকাতেও বিকোয় পমফ্রেট। একটা সময়ে, আড়াই-তিন দশক আগেও পমফ্রেটকে বাঙালির ভাতের পাতে কুলীন মাছ বলে মর্যাদা দেওয়া হত না। সেই সময়ে পমফ্রেটের দাম কই-পারশে-ভেটকি-ট্যাংরা, এমনকী রুই-কাতলার চেয়েও কম ছিল। এখন যেমন মূলত সিলভার পমফ্রেট মেলে, তখন একাধিক প্রজাতির পমফ্রেট পাওয়া যেত। সেই সময়ে বাজারে হামেশাই মিলত ব্ল্যাক পমফ্রেট, মৎস্যজীবী ও বিক্রেতাদের একাংশের কাছে যার চলতি নাম হালুয়া। সেটা এতটাই ওজনের যে, এক-একটি পমফ্রেট মাথা, ধড় ও ল্যাজা— তিন ভাগে কেটে নিতে হত। এখন আর সেই পমফ্রেটের দেখা কার্যত মেলে না। তবে বেঙ্গালুরুর মতো শহরের বাজারে বড় ব্ল্যাক পমফ্রেট এখন ১২০০ টাকা কেজি দরেও বিকোচ্ছে। এই রাজ্যে ইলিশ মাছের যেমন দাম।
তা ছাড়া, পমফ্রেট মাছের গুণ সম্পর্কে ক্রমশ জেনে, একটা মাত্র কাঁটা থাকার কারণে ও আঁশযুক্ত মাছের আঁশটে গন্ধ না থাকার ফলে পমফ্রেটের চাহিদা মৎস্যপ্রিয় ও নতুন প্রজন্মের বাঙালির কাছে উত্তরোত্তর বেড়েছে। কই-পারশে-ট্যাংরা পাতে না তোলা এক শ্রেণির বাঙালিও এখন দিব্যি খাচ্ছেন পমফ্রেট মাছ।
অথচ পমফ্রেট যখন এই রাজ্যের অন্যতম প্রিয় মাছ হয়ে উঠেছে, তখন কমতে শুরু করেছে তার জোগানও। টাকা দিয়েও অনেক সময়ে পমফ্রেট মেলে না। পমফ্রেটের এই আকালের পিছনে এল নিনো ফ্যাক্টর দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। আবার তাঁদের কারও কারও মতে, জাহাজের জ্বালানি পড়ে বা অন্যান্য কারণে সমুদ্রে দূষণের ফলে প্রয়োজনীয় খাবারের অভাবে ও অনুকূল পরিবেশ না পেয়ে বহু প্রজাতির মাছ তাদের জায়গা বদল করছে। একই ভাবে পমফ্রেটও পশ্চিমবঙ্গের উপকূল ছেড়ে অনেক সময়েই অন্যত্র চলে যাচ্ছে বলে মনে করছেন ওই বিশেষজ্ঞরা।
রাজ্য মৎস্য উন্নয়ন নিগমের মতে, পমফ্রেটের সুলভ জোগান নিশ্চিত করাটা তাদের হাতে নেই। কিন্তু বিকল্প মাছের জোগান নিশ্চিত করাটা তাদের হাতে আছে। আর সেই জন্যই সিলভার পমপ্যানোর আবির্ভাব।
অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, গোয়া, মহারাষ্ট্রে এই মাছ ভাল পরিমাণে মেলে। ভারতে সিলভার পমপ্যানোর কৃত্রিম প্রজননের কাজ প্রথম করে সেন্ট্রাল মেরিন ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিএমএফআরআই)। তামিলনাড়ুর মান্দাপামে ওই সংস্থার রিজিওনাল সেন্টার থেকে সিলভার পমপ্যানোর দশ হাজার চারা নিয়ে এসে গত বছর এপ্রিলে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার আলমপুরে পরীক্ষামূলক ভাবে চাষ শুরু করে রাজ্য মৎস্য দফতর। তাদের দাবি, এ বছর সেপ্টেম্বরে আলমপুরে নিগমের হ্যাচারি থেকে তোলার সময়ে দেখা গেল, ৮৫ শতাংশই বেঁচে আছে এবং চারা থেকে মাছ হওয়ার পর এক-একটির ওজন গড়ে হয়েছে তিনশো গ্রাম। মৎস্য দফতর ওই মাছ তিনশো টাকা কেজি দরে বাজারে বিক্রিও করেছে। নিগমের জেনারেল ম্যানেজার বিজন কুমার মণ্ডল বলেন, মোট প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ টাকার মাছ সরকারের পক্ষ থেকে বিক্রি করা হয়েছে লেকটাউন, কালিন্দী, সল্টলেক, রাজারহাট, ভবানীপুর, কেষ্টপুরের বাজারে।
মৎস্য দফতরের বিশেষজ্ঞরা জানান, সামুদ্রিক মাছ হওয়ায় সিলভার পমপ্যানো নোনা জলেই চাষযোগ্য। সেই জন্য দুই ২৪ পরগনা ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলাকে সিলবার পমপ্যানো চাষের উপযুক্ত জায়গা বলে গণ্য করা হচ্ছে। আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে ওই তিন জেলায় পমপ্যানো চাষের কাজ জোর কদমে রাজ্য মৎস্য উন্নয়ন নিগম শুরু করবে। নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সৌম্যজিৎ দাস বলেন, ‘‘ইতিমধ্যেই পূর্ব মেদিনীপুরের ৪৩টি মৎস্যজীবী সমিতি সিলভার পমপ্যানো চাষ করতে আমাদের কাছে আবেদন জানিয়েছে। এক-একটি সমিতিতে মৎস্যজীবীর সংখ্যা ২৫-৩০ জন। দু’মাস পরেই আমরা তাঁদের হাতে পমপ্যানোর চারা তুলে দেব।’’
এখন দেখার, পমফ্রেটের বিকল্প— এই পরিচয়ের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে সিলভার পমপ্যানো বাঙালির পাতে আলাদা জায়গা করে নেয় কি না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy