নায়ক ও-পারের, নায়িকা এ-পারের। এক দিন শেষ মুহূর্তে শ্যুটিং কেঁচে গিয়েছিল। বহু কষ্টে নতুন ডেট মিলেছে। বাংলাদেশের শাকিব খান ও পশ্চিমবঙ্গের শ্রাবন্তীকে নিয়ে তৈরি হতে চলা নতুন ছবির প্রযোজক সে কথা জানিয়েও দিয়েছিলেন ফেডারেশনকে।
ফেডারেশন, মানে টালিগঞ্জের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কলাকুশলীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা— ফেডারেশন অব সিনে টেকনিশিয়ান্স অ্যান্ড ওয়ার্কার্স অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া। শ্যুটিংয়ের আগের দিন সন্ধে পর্যন্ত তারা ছাড়পত্র দেয়নি! শুক্রবার বোলপুরে শ্যুটিংটা যে করা যাবে, প্রযোজক হিমাংশু ধানুকা তা জানতে পারেন বৃহস্পতিবার রাত ন’টা নাগাদ! সব আয়োজন সেরে লোকেশনে বসে অপেক্ষা করতে করতে ততক্ষণে দুশ্চিন্তা আর
উদ্বেগে গোটা ইউনিটের চুল খাড়া হওয়ার জোগাড়!
‘শিকারী’ ছবির শ্যুটিং ঘিরে রক্তচাপ বাড়ানো এ হেন টানাপড়েনের নেপথ্য ‘কারিগর’ হিসেবে আঙুল উঠেছে ফেডারেশনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাসের দিকে। অভিযোগ, স্বরূপের আপত্তিতেই শেষ মুহূর্ত অবধি শ্যুটিং ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। এ-ও অভিযোগ, এটা এক দিনের ব্যাপার নয়। হামেশাই নির্মীয়মাণ নানা ছবির শ্যুটিং কাঁচিয়ে দিয়ে কিংবা টালবাহানা চালিয়ে পুরো ইউনিটকে চূড়ান্ত ভোগান্তিতে ফেলা হচ্ছে। ‘‘পছন্দের লোকজনকে না-নিলেই কোপ। এ
যেন সিনেমার সিন্ডিকেট!’’— মন্তব্য এক পরিচালকের।
ঘটনা হল, টালিগঞ্জের বিনোদন জগতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৎপরতার অন্ত নেই। এবং ঘটনাচক্রে স্বরূপের দাদা তথা মমতার বিদায়ী মন্ত্রিসভার সদস্য অরূপ বিশ্বাসের হাত ধরেই গোটা টালিগঞ্জকে শাসকদলের তাঁবুর নীচে আনার উদ্যোগের সূচনা। কিন্তু ইদানীং তাঁরই ভাইয়ের ‘দাদাগিরি’তে তিষ্ঠোনো যাচ্ছে না বলে ইন্ডাস্ট্রির আনাচে-কানাচে গুঞ্জন।
সূত্রের খবর: তৃণমূলনেত্রী একাধিক বার বলেছেন, ইন্ডাস্ট্রি-র স্বার্থে কখনওই শ্যুটিং বন্ধ করা যাবে না। অথচ স্বরূপ গোষ্ঠীর দাপটে সেটাই ঘটছে বারবার। প্রযোজককে লাখ-লাখ টাকা গুণাগার দিতে হচ্ছে। কখনও লন্ডনে শ্যুটিংয়ে গিয়ে ধানুকার ইউনিটকে সারা দিন হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। কখনও ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের বিদেশ-শ্যুটিংয়ে কোন কলাকুশলী যাবে না-যাবে’র নিষ্পত্তি করতে শাসকদলের শীর্ষস্তরের হস্তক্ষেপ দরকার পড়ছে। টলিউডের একাংশের দাবি, কোন শ্যুটিংয়ে কোন কলাকুশলী যাবেন, স্বরূপ-শিবিরই ঠিক করে দিচ্ছে। প্রযোজক তা না-মানলেই বিপত্তি। এমনকী, ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শিক্ষানবিশ পরিচালকদেরও ফেডারেশন রেয়াত করছে না বলে অভিযোগ।
ফলে কেউ কেউ শ্যুটিং শিকেয় রেখে ফিরে যাচ্ছেন। টালিগঞ্জের এক পোড়খাওয়া পরিচালকের শ্লেষ, ‘‘এ হল গিয়ে ইমারতি সিন্ডিকেটের ফিল্মি সংস্করণ! ইট-চুন-বালি-সিমেন্টের মতো ফিল্ম ইউনিটের একস্ট্রা, ট্রলিকর্মী, ইলেকট্রিশিয়ান থেকে শুরু করে প্রডাকশনের লোকলস্করও স্বরূপ তথা রুলিং পার্টির ঘনিষ্ঠেরা ঠিক করে দিচ্ছেন!’’ বোলপুর-কাণ্ড নিয়ে এ দিন টুইটারে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিজেপি নেত্রী তথা অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়ের খোঁচা, ‘‘অরূপ বিশ্বাসের ভাই স্বরূপ বিশ্বাস তো গোটা ইন্ডাস্ট্রিকে পণবন্দি করে রেখেছেন।’’
‘স্বরূপ-রাজের’ নানা নমুনার বৃত্তান্ত টলিউডে মুখে মুখে ফিরছে। শোনা যাচ্ছে, মাসখানেক আগে ভেঙ্কটেশ-গোষ্ঠীর ‘লাভ এক্সপ্রেস’ ঘিরে গোলমাল তুঙ্গে ওঠে। দেব-নুসরত অভিনীত ছবিটির একটি গানের শ্যুটিংয়ে তুরস্কে বাড়তি
এক জনকে পাঠানোর দাবিতে
স্বরূপ-গোষ্ঠী জেদ ধরে ছিল।
শেষমেশ তৃণমূলের তারকা সাংসদ দেবই দলের শীর্ষ স্তরে যোগাযোগ করে পরিস্থিতি সামলান।
দেব অবশ্য এ প্রসঙ্গে মুখ খোলেননি। এ দিন তাঁকে ফোন বা এসএমএস করে সাড়া মেলেনি। তবে ভেঙ্কটেশের কর্ণধার শ্রীকান্ত মোহতার মন্তব্য, ‘‘কিছু ঝামেলা হয়েছিল। আলোচনায় মিটে গিয়েছে। আশা করি, সব ঠিক থাকবে।’’ কিন্তু শ্রীকান্ত তো মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের
লোক! শাসকের সিন্ডিকেটের কোপ ওঁর ঘাড়ে কেন?
টলিউডের একাংশের দাবি: এখানে মুখ্য ভূমিকা অরূপের। শ্রীকান্ত-মমতা সরাসরি যোগাযোগের পরিণামে টলিউডে অরূপের প্রতিপত্তির রাশ আলগা হয়েছে। ‘‘তৃণমূলের মিটিং-মিছিলে তারকা হাজির করতে মমতার এখন শ্রীকান্তই যথেষ্ট। তাই ভাইয়ের মাধ্যমে ভেঙ্কটেশকে ‘সাইজ’ করতে চাইছে অরূপের ক্যাম্প।’’— পর্যবেক্ষণ
এক প্রযোজকের।
তবে ইন্ডাস্ট্রির অন্দরের ইঙ্গিত, ভেঙ্কটেশ অত সহজে ছেড়ে দেবে না। ফেডারেশনের ‘জুলুমবাজি’ রুখতে তারা জোট বাঁধার তোড়জোড় করছে। এক প্রযোজকের অনুমান, ‘‘আজ না হোক কাল, স্বরূপদের দাদাগিরির বিরুদ্ধে এককাট্টা পদক্ষেপ দেখা যেতেই পারে।’’
এবং টলিউডের অন্দরের এই ক্ষোভের আঁচে ভোটের মুখে টালিগঞ্জের তৃণমূল প্রার্থী অরূপ বিশ্বাস বিলক্ষণ প্যাঁচে। তিনি লোকজনকে বোঝাচ্ছেন, কিছু ‘ছুটকো-ছাটকা’ ঘটনা দেখিয়ে তিলকে তাল করা হচ্ছে। ভাই সম্পর্কে ইন্ডাস্ট্রির ‘বিরূপ’ মনোভাবের বিষয়টিও তাঁর অজানা বলে এড়িয়ে যাচ্ছেন বিদায়ী মন্ত্রী। যুক্তি দিচ্ছেন, ‘‘ফেডারেশনে অজস্র গিল্ড। সকলে সর্বভারতীয় সংস্থার নিয়মে চলে। বিশেষ কেউ সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।’’ স্বরূপও অভিযোগ মানেন না। তাঁর বক্তব্য, ‘‘অনেকে মিলে কাজ করলে কিছু কথা উঠবেই! কলাকুশলী, প্রযোজক— আমরা সবার স্বার্থ দেখি।’’
ওঁরা যা-ই বলুন, টালিগঞ্জে ফেডারেশনের অন্তর্গত ২৬টি গিল্ডেই স্বরূপ গোষ্ঠীর ‘সিন্ডিকেটবাজি’র অভিযোগ মজুত। রাজ্যে পালাবদলের পরে স্বরূপ এ নিয়ে তিন বার ফেডারেশনের সভাপতি পদে জিতে এসেছেন। গত চার বছরে বিভিন্ন গিল্ডে দু’-তিন হাজার বাড়তি লোকও ঢুকেছে, যাঁদের অনেকের যোগ্যতা নিয়ে প্রশাতীত নয়। ‘‘তবু এঁদের বিভিন্ন শ্যুটিংয়ে সুযোগ দেওয়া বা বিদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ বাড়ছে।’’— খেদ এক গিল্ড সদস্যের।
শিকারী-কাণ্ডে এই জুলুমের চেহারা প্রকট হয়েছে বলে অনেকের দাবি। কী রকম?
টলি-সূত্রের খবর: ফেডারেশনের নেতাদের পছন্দের ‘ড্যান্সার’ না-নেওয়ায় গত ২০ এপ্রিল বোলপুরে শ্রাবন্তী-শাকিবের শ্যুটিং বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এ দিন (২৯ এপ্রিল) বাকি থাকা অংশের কাজ শেষ করতে ফেডারেশনে আবেদন করা হয়। ফেডারেশন জানায়,
পনেরো দিন আগে আবেদন না-করলে কিছু হওয়ার নয়। প্রচুর
পীড়াপীড়ি শেষে একেবারে অন্তিম লগ্নে অনুমতি এসেছে।
ফলে ভোগান্তির চূড়ান্ত। এখানেই শেষ নয়। ‘শিকারী’র প্রযোজক— এসকে মুভিজের কর্তা হিমাংশু ধানুকার অভিযোগ, লন্ডনে ১ মে থেকে অঞ্জন দত্তের ‘বংস
আগেন’ বা ১৫ মে থেকে জিৎ-অভিনীত ‘বাদশা’র নির্ধারিত
শ্যুটিং নিয়েও জটিলতা তৈরি করা হচ্ছে। গিল্ডের নিয়ম অনুযায়ী, বিদেশের শ্যুটিংয়ে ১৯ জনের বেশি কলাকুশলী নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। ‘‘এ দিকে ফেডারেশন আমাদের বলছে, ২৩ জনকে নিয়ে যেতে হবে! এত লোকের ভিসা জোগাড়
করতেই তো হিমসিম খাচ্ছি!’’— আক্ষেপ ধানুকার।
কী করা যায়, কুল-কিনারা পাচ্ছেন না ওঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy