এই বছর ২৮ এপ্রিল আমেরিকার ফ্লরিডায় ৮০ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন উইলিয়াম ল’স ক্যালে জুনিয়র। ২০২৪ সালের আমেরিকায় তাঁর নাম খুব বেশি কেউ জানতেন না, ফলে তাঁর মৃত্যু তেমন আলোড়ন ফেলেনি। যে দেশটিতে তাঁর মৃত্যুসংবাদের তাৎপর্য বিপুল হতে পারত, সেই দেশটির নাম ভিয়েতনাম। যুদ্ধাপরাধের ইতিহাসে নৃশংসতম ঘটনাগুলির অন্যতম ঘটেছিল ভিয়েতনামেই— ১৯৬৮ সালের ১৬ মার্চ মাই লাই নামে এক গ্রামে, কার্যত কোনও কারণ ছাড়াই, ৫০০-র বেশি গ্রামবাসীকে হত্যা করেছিল আমেরিকান সেনা; ধর্ষণ করেছিল বালিকা থেকে বৃদ্ধা অবধি অগণন নারীকে; পুড়িয়ে দিয়েছিল ঘরবাড়ি, খেতখামার, গবাদি পশু। সেই নৃশংসতার পান্ডা ছিলেন প্লাটুন কম্যান্ডার ক্যালে। পরবর্তী কালে আমেরিকায় যুদ্ধাপরাধ বিচারের নামে একটি প্রহসন হয়— উইলিয়াম ক্যালে জুনিয়র তাতে অপরাধী সাব্যস্ত হন; তবে, এই নৃশংসতার শাস্তি হিসাবে তিনি বছরতিনেক গৃহবন্দি ছিলেন। সেই ঘাতকের মৃত্যুসংবাদ ভিয়েতনামে আলোড়ন ফেলতে পারত। ফেলেনি। কেন, সেই সন্ধান করেছিলেন এক কৌতূহলী সাংবাদিক। দেখা গেল, ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরে যাঁদের জন্ম, তাঁদের অনেকে সেই নৃশংসতার খলনায়কের কথা জানেনই না— বরং, তাঁরা সেই সব আমেরিকান সেনার কথা জানেন, যাঁরা চেষ্টা করেছিলেন আক্রান্ত ভিয়েতনামি মানুষকে কোনও ভাবে রক্ষা করার। আর, যাঁরা ১৯৬৮ সালের নৃশংসতার সাক্ষী, তাঁদের মধ্যেও অনেকেই জানিয়েছেন যে, ক্যালেকে নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করেন না তাঁরা— সেই ভয়াবহতা ভুলতে পারেননি, কিন্তু ক্ষমা করে দিয়েছেন।
বছর দুয়েক আগে এ কথাটিই বলেছিলেন ফান থি কিম ফুক। কানাডার সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মানে ভূষিত এই ষাটোর্ধ্ব নারীকে গোটা দুনিয়া অবশ্য অন্য নামে চেনে— ‘দ্য নাপাম গার্ল’। আক্ষরিক অর্থেই ভিয়েতনামে আমেরিকার বর্বরতার জ্বলন্ত প্রমাণ। ১৯৭২ সালের ৮ জুন দক্ষিণ ভিয়েতনামের ট্র্যাং ব্যাং গ্রামে আমেরিকান যুদ্ধবিমান নাপাম বোমা ফেলে— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আবিষ্কৃত এই বোমায় ব্যবহৃত রাসায়নিকের বৈশিষ্ট্য হল, যেখানে সেই বোমা থেকে আগুন লাগে, সে আগুন ছাড়ানো যায় না কিছুতেই। ন’বছর বয়সি কিম ফুকের পিঠে আগুন লেগেছিল নাপাম বোমা থেকে— জ্বলন্ত অবস্থায় ছুটে আসছে সে, নিক উট নামক চিত্রসাংবাদিকের তোলা এই ছবিটি গোটা দুনিয়া ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতীক হিসাবে চেনে। ২০২২ সালে কিম ফুক বলেছিলেন, পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গিয়েছে— আমি আর ‘নাপাম গার্ল’ নই। অর্থাৎ, সেই নৃশংসতার স্মৃতিকেই তাঁর পরিচিতি হিসাবে নাকচ করেছিলেন কিম ফুক।
যে ভয়াবহতার দাগ অনপনেয়, তাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারার কাজটি ব্যক্তিগত স্তরেও কঠিন, সমষ্টিগত স্তরেও কঠিন। তার চেয়ে অনেক সহজ অতীতের ক্ষত পুষে রাখা, সেই রাগকেই ব্যবহার করে চলা ধ্বংসাত্মক চালিকাশক্তি হিসাবে। ক্ষমার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, পুষে রাখা রাগের খোঁজ না চাইতেই মেলে। রাজনীতি সে খোঁজ রাখে। কারণ, নেতিবাচক রাজনীতির— বিশেষত কোনও এক ‘সর্বশক্তিমান’ সর্বাধিপত্যকামী নেতার দ্বারা চালিত রাজনীতির— উপজীব্য হল প্রতিশোধ। কোনও এক বাস্তব বা কল্পিত অবিচারের বদলা নেওয়া। ফলে, ক্ষমার মধ্যে নিহিত মুক্তি— যাঁকে ক্ষমা করা হচ্ছে, তাঁর চেয়েও বেশি, যিনি ক্ষমা করছেন, তাঁর মুক্তি— বিশ্বের হরেক জনগোষ্ঠীর অধরাই থেকে যায়। সামগ্রিক ভাবে ভিয়েতনামও আমেরিকাকে ক্ষমা করতে পেরেছে কি না জানা নেই। কিন্তু, অন্তত ব্যক্তিগত স্তরে এই কঠিন কাজটি যাঁরা পেরেছেন, তাঁরা বুঝেছেন, পুষে রাখা ঘৃণার থেকে মুক্তি আসলে নিজেকে স্বাধীন হতে দেওয়া। রাষ্ট্রনায়করা এই স্বাধীনতার কথা সচরাচর বলেন না। কিন্তু, সাধারণ মানুষ কি নিজের মতো করে এই স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে না? ভুলতে পারে না অতীতের ক্ষত ও ক্ষতি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy