Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

নৃশংস খুনের সাত নজির

ব্যাগ ভর্তি দেহাংশ গঙ্গায় ফেলতে গিয়ে সহ-যাত্রীদের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন দুর্গাপুরের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কের ম্যানেজার সমরেশ সরকার। তদন্তে পুলিশ জেনেছে তিনি এক মহিলা এবং একটি শিশুর দেহাংশ ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছিলেন। ঘটনার নৃশংসতায় অনেকেই হতবাক হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, এটা অতি বিরল ঘটনা নয়। গত ১৫ বছরের তথ্যপঞ্জি ঘেঁটে পুলিশ কলকাতা এবং সংলগ্ন এলাকায় এমন সাতটি ঘটনার কথা জানাচ্ছে, যেখানে খুনের পরে দেহ কেটে কেটে ব্যাগ, বস্তা কিংবা ট্রাঙ্কে ভরে পাচার করা হয়েছে অন্যত্র।

শিবাজী দে সরকার
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৫ ১৬:৫৭
Share: Save:

ব্যাগ ভর্তি দেহাংশ গঙ্গায় ফেলতে গিয়ে সহ-যাত্রীদের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন দুর্গাপুরের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কের ম্যানেজার সমরেশ সরকার। তদন্তে পুলিশ জেনেছে তিনি এক মহিলা এবং একটি শিশুর দেহাংশ ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছিলেন। ঘটনার নৃশংসতায় অনেকেই হতবাক হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, এটা অতি বিরল ঘটনা নয়। গত ১৫ বছরের তথ্যপঞ্জি ঘেঁটে পুলিশ কলকাতা এবং সংলগ্ন এলাকায় এমন সাতটি ঘটনার কথা জানাচ্ছে, যেখানে খুনের পরে দেহ কেটে কেটে ব্যাগ, বস্তা কিংবা ট্রাঙ্কে ভরে পাচার করা হয়েছে অন্যত্র।

এর মধ্যে দু’টি ঘটনায় মৃতদেহ শনাক্তই হয়নি। ওই দু’টি ঘটনাই রেল পুলিশ এলাকার। রেল পুলিশ অবশ্য গত বছরের একটি ঘটনার কিনারা করে ফেলেছে। আর কলকাতা পুলিশের এলাকায় ঘটা চারটি এই ধরনের ঘটনায় সব ক’টি ক্ষেত্রেই পুলিশ শেষ পর্যন্ত মৃতদেহ শনাক্ত করে এবং অপরাধী ধরা পড়ে। যে দু’টি ঘটনায় রেল পুলিশ মৃতদেহ শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ তার একটি ১৫ বছর আগেকার। অন্যটি সাড়ে তিন বছরের পুরনো। দু’টি মৃতদেহের একটি মহিলার। অন্যটি পুরুষের। দু’টি ক্ষেত্রেই বস্তা কিংবা ব্যাগে বন্দি দেহাংশ পাওয়া গিয়েছিল রেলের কামরা কিংবা রেল লাইনের আশপাশ থেকে।

• ডানকুনি লোকালের দেহ

২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শিয়ালদহ স্টেশনে ডানকুনি লোকালের একটি কামরায় সাদা রঙের একটি ব্যাগের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল নাভি থেকে ঊরু পর্যন্ত কাটা নুনমাখা দেহাংশ। কল্যাণী স্টেশনে আগের দিন রাতে রেল লাইনের ধারে মিলেছিল একটি ব্যাগ। তাতে মিলেছিল একটি পুরুষের মাথা-সহ দেহের বিভিন্ন অংশ। তদন্তে নেমে রেল পুলিশ দু’টি ব্যাগের দেহাংশ জোড়া দিয়ে দেখেছিল সেটি একটি পুরুষের।

ঘটনার পরে কেটে গিয়েছে সাড়ে তিন বছর। কিন্তু ওই দেহের মালিক কে সেটাই এখনও পর্যন্ত জানতে পারেনি রেল পুলিশ। বিভিন্ন রেল স্টেশনে নিহতের ছবি এবং তার সঙ্গে পাওয়া জিনিসপত্রের ছবি পাঠিয়েছিল রেল পুলিশ। ছবি গিয়েছিল বিভিন্ন থানাতেও। খুন করার পর কার দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে বস্তায় ভরে বিভিন্ন স্টেশনে ফেলে দেওয়া হয়েছিল সেই রহস্যের কিনারাই করতে পারেনি পুলিশ। ফলে তদন্তের কাজ আর এগোয়নি।

• ডাউন চেন্নাই মেল

ঠিক একই ভাবে ১৫ বছরেও রেল পুলিশ জানতে পারেনি ২০০০ সালে ডাউন চেন্নাই মেলে বস্তায় মুড়ে কোন মহিলার মাথা এবং দু’টি হাত রেখে গিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। ওড়িশার বোলাঙ্গির স্টেশনে এক মহিলার ধড় এবং হায়দরাবাদের নামপল্লি স্টেশনে এক মহিলার দু’টি পা উদ্ধার হওয়ার পরে সব অংশ জোড়া দিয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয় যে, মৃতদেহটি একই মহিলার। কিন্তু সেই মহিলা কে, তাঁকে কারা খুন করল তা জানতে না পারায় ওই ঘটনার তদন্তই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

• টিভির বাক্সে দেহ কার

লালবাজার সূত্রের খবর, ২০০৩ সালের নভেম্বরে পারিবারিক গোলমালের জেরে মিটন দাস নামে এক ব্যক্তিকে খুন করে তাঁরই পরিবারের দুই সদস্য। খুনের পর মিটনের দেহ দু’টুকরো করে অভিযুক্তরা। পরে একটি টিভির বাক্সে মাথা থেকে ঊরু পর্যন্ত দেহাংশ ভরে ফেলে দেওয়া হয় বেলেঘাটা চাউল পট্টি রোডের ধারে একটি খালে। তদন্তে নেমে অবশ্য অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে পুলিশ।

• শপিং ব্যাগে শিশু

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে উল্টোডাঙায় খালের কাছে একটি শপিং ব্যাগের মধ্যে উদ্ধার হয় এক বছরের শিশু ইন্দ্রজিৎ সাহার দেহ। খুনের পরে মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে কেটেছিল দুষ্কৃতীরা। এক দিন পরে ডানকুনি টোলপ্লাজার কাছে বস্তাবন্দি অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ওই শিশুর মা বুলা সাহার মৃতদেহ। চার্জশিটে পুলিশ জানায়, পারিবারিক বিবাদের জেরে ওই শিশুকে এবং তার মাকে খুন করেছিল পরিবারেরই দুই সদস্য।

• টিনের বাক্সে মহিলা

বুলা সাহা কাণ্ডের ঠিক ছ’মাসের মাথায় নারকেলডাঙ্গা খালের পাশে রেল ব্রিজের নীচে একটি টিনের বাক্সের মধ্যে থেকে উদ্ধার হয় ক্ষতবিক্ষত এক মহিলার দেহ। পরে জানা যায় ওই মহিলার নাম স্বপ্না চক্রবর্তী। টিনের বাক্সের সূত্র ধরেই ওই খুনের কিনারা করে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অফিসাররা।

• বার কোডে সমাধান

কলকাতা পুলিশে দীর্ঘ দিন হোমিসাইড বিভাগে কাজ করা এক গোয়েন্দা অফিসারের কথায়, ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটেছিল ২০১১ সালে নিউ আলিপুর। একটি টিভির বাক্সের ভিতর ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় এক প্রতিবন্ধী মহিলার দেহ। এমন ভাবে মহিলার দেহের বিভিন্ন অশে ধারালো অংশ দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল যে মৃতদেহটি শনাক্ত করারই উপায় ছিল না। পরে ওই টিভি বাক্সের উপরে টিভি নির্মাতা সংস্থার ‘বার কোড’ দেখে মহিলাকে শনাক্ত করে কলকাতা পুলিশ। মহিলার এক আত্মীয়কে গ্রেফতার করেন গোয়েন্দারা।

• বেডিংয়ের ভিতরে কাটা দেহ

গত বছর ২০ মে শিয়ালদহ স্টেশনের ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের কাছে একটি ট্রলি ব্যাগ এবং বেডিং পড়ে থাকতে দেখেন রেল পুলিশকর্মীরা। পরে তা খুলে তাজ্জব হয়ে যান পুলিশকর্মীরা। বেডিংয়ের মধ্যে চাদরে মোড়া গলা থেকে কোমড়। আর ট্রলি ব্যাগের মধ্যে মহিলার মাথা, কাটা হাত-পা মেলে। পরে ওই ট্রলি ব্যাগের সূত্র ধরে পুলিশ জানতে পারে ওই মহিলার নাম জয়ন্তী দেব। ওই ঘটনায় মহিলার স্বামী-সহ তিন জনকে গ্রেফতার করেছিল রেল পুলিশ। লেকটাউনের বাড়িতে খুন করার পর রাতের অন্ধকারে ফেলে যাওয়া হয় শিয়ালদহ স্টেশনের বাইরে।

কিন্তু মানুষ এত নৃশংস হয় কী ভাবে?

মনস্তত্ত্ববিদ অনিরুদ্ধ দেব বলেন, ‘‘পৃথিবীতেই এই রকম ঘটনা বারে বারে ঘটেছে। মূলত দু’টি উদ্দেশ্য নিয়েই খুন করার পর দেহ কেটে টুকরো করে ফেলে দেওয়া হয়। প্রথমত, যাকে খুন করা হচ্ছে তাঁকে যাতে শনাক্ত না করা যায়। দ্বিতীয়, খুনের প্রমাণ লোপাটের জন্যে দেহ টুকরো করলে তা সহজেই ব্যাগে বা বস্তায় ভরে নিয়ে যাওয়া যায়।’’ প্রিয়জনকে এ ভাবে খুন করার মানসিক জোরই বা ওই সব খুনি পায় কোথা থেকে? অনিরুদ্ধবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘কিছু কিছু মানুষ অতি নৃশংস হয়। সেটাই তার মানসিক অবস্থা। যাদের মধ্যে নৃসংশতা বেশি তারা খুব সহজেই খুনের পর দেহ কেটে ফেলার মানসিক শক্তি দেখাতে পারে।’’

পনের বছরে সাত

২০০০— হাওড়া স্টেশনে চেন্নাই মেলের কামরায় বস্তায় মোড়া একটি কাটা মাথা এবং দু’টি হাত উদ্ধার।

২০০৩— বেলেঘাটা চাউলপট্টিতে টিভির বাক্সের মধ্যে মিলল মাথা থেকে উরু পর্যন্ত দেহাংশ।

২০০৮— উল্টোডাঙ্গায় খালের মধ্যে শপিং ব্যাগ থেকে উদ্ধার এক বছরের শিশুর ক্ষতবিক্ষত দেহ।

২০০৯— নারকেলডাঙ্গা থানা এলাকায় রেল ব্রিজের নিচে টিনের বাক্সে ক্ষতবিক্ষত মহিলার দেহ।

২০১১— নিউ আলিপুরে টিভির বাক্সের মধ্যে থেকে উদ্ধার প্রতিবন্ধী মহিলার দেহ।

২০১২— শিয়ালদহ এবং কল্যাণী স্টেশন থেকে উদ্ধার ব্যাগ ভর্তি দেহাংশ।

২০১৪— শিয়ালদহ স্টেশনের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে বাইরে ট্রলি ব্যাগ এবং বেডিং-এ বন্দি মহিলার কাটা দেহ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE