কয়েকটা বছর শুধু পিছিয়ে যেতে হবে। ২০০৭ সালের ৬ ডিসেম্বর অবধি।
সে দিন বিধানসভার অধিবেশন বসতেই সরব হয়েছিলেন ধুতি-পাঞ্জাবি শোভিত এক তৃণমূল বিধায়ক। অভিযোগ এনেছিলেন, স্টিং অপারেশনে সিপিআই বিধায়ক শেখ ইলিয়াস মহম্মদকে ঘুষ নিতে দেখা গিয়েছে। দাবি করেছিলেন, এর ফলে বিধানসভা ও বিধায়কদের সম্মানহানি ঘটেছে। ইলিয়াসের বিরুদ্ধে স্বাধিকার ভঙ্গের প্রস্তাব সভায় উত্থাপন করেছিলেন তিনিই।
সেই সৌগত রায় এখন দমদমের তৃণমূল সাংসদ। সোমবার প্রকাশিত নারদের স্টিং ভিডিওতে যাঁকে পাঁচ লক্ষ টাকা নিতে দেখা গিয়েছে। অথচ তাই নিয়ে প্রশ্ন করলে সংসদ চত্বরে এখন সেই সৌগতবাবুই ঝাঁঝিয়ে জবাব দিচ্ছেন, ‘‘মানুষকে অপমান করবেন না!’’
নারদ নিয়ে সরগরম ভোট-বাজারে বাস্তবিকই আলাদা বিস্ময় আদায় করে নিয়েছেন সৌগত। তাঁর সম্পর্কে বিরোধী দলের এক সাংসদ বলছেন, ‘‘এট টু ব্রুটাস!’’ দলের এক সতীর্থ বলছেন, ‘‘উনি বারেবারে তৃণমূলের বিবেক হয়ে ওঠার চেষ্টা করতেন। এ বার তবে কী হল!’’ সাধারণ্যেও বেশির ভাগ মানুষেরই প্রশ্ন— অধ্যাপক মানুষটি এত দিনের ভাবমূর্তি নিজে হাতে নষ্ট করলেন?
এই বিস্ময় সৌগতবাবুর অতীত রেকর্ডের অর্জন।
অতীতের পাতাই মনে করাচ্ছে নন্দীগ্রামের প্রাক্তন সিপিআই বিধায়ক ইলিয়াস ঘুষ-কাণ্ডে অভিযুক্ত হন একটি চ্যানেলের স্টিং অপারেশনের জেরে, যার হোতা ছিলেন তদানীন্তন সাংবাদিক, অধুনা তৃণমূল নেতা শঙ্কুদেব পণ্ডা। বিধানসভায় তাই নিয়ে হইচই করেছিলেন সৌগতই। নথি বলছে, বিধানসভার স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম অভিযোগের সিডি চেয়েছিলেন। সৌগতবাবু বলেছিলেন, তিনি সিডি সংগ্রহ করে দেবেন। কেন একটা স্টিং অপারেশনের জেরে স্পিকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে, সে প্রশ্ন সে দিন ওঠেনি। বরং সৌগতবাবুদের চাপেই স্পিকার সে দিন কংগ্রেস বিধায়ক জ্ঞান সিংহ সোহনপালের নেতৃত্বে একটি কমিটি গড়ে দিয়েছিলেন। কমিটিতে ছিলেন তৎকালীন বিরোধী দলনেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সিপিএমের মুস্তাফা বিন কাশেম (অধুনা প্রয়াত) প্রমুখ।
কমিটির রিপোর্ট আসার জন্য ইলিয়াস অবশ্য অপেক্ষা করেননি। ইস্তফা দিয়েছিলেন বিধায়ক ও দলের সদস্যপদ থেকে। নন্দীগ্রামের চৌরঙ্গি বাজারের বাড়ি থেকে বুধবার সন্ধ্যায় ভেসে এল সেই ইলিয়াসের দুর্বল কণ্ঠ— ‘‘সৌগতবাবু ইস্তফা দিয়ে মানটা রাখতে পারতেন! সে দিন কিন্তু তৃণমূল বিধায়কেরা আমার নামে ‘চোর’, চোর’ বলে চেঁচিয়েছিলেন!’’
সৌগতবাবু ইস্তফা তো দেনইনি। বরং নারদে নাম জড়ানোর পরে তাঁকে লোকসভায় ফেটে পড়তে দেখেছে দেশ! সিপিএমের মহম্মদ সেলিমকে যিনি ধমকে বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন! স্পিকার সুমিত্রা মহাজন অভিযোগটি এথিক্স কমিটিতে পাঠাতে যাচ্ছেন দেখে প্রতিবাদ করেছেন, ‘‘ম্যাডাম, আপনি কারও বক্তব্য না শুনে একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন! এটাই যদি সংসদের রেওয়াজ হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে যে কেউ এখন থেকে স্টিং অপারেশন করবে।’’
সৌগতবাবুর নামে অভিযোগ নতুন, তাঁর এই রাগত চেহারাটাও নতুন। কামারহাটিতে কর্মিসভা করতে গিয়ে সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী এ দিনই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘তা-ই বলে সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সৌগত রায়ও?’’ উত্তরটাও নিজেই দিয়েছেন, ‘‘অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ!’’ সেলিম বলছেন, ‘‘সে বার বিধানসভায় উনি যা বলেছিলেন, আমি তার চেয়ে আলাদা কী বলেছি? আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শেখাও, এই কথাটুকুও ওঁর জন্য খাটল না!’’
সেই তিনি আর এই তিনি-র তফাত বুঝতে সৌগতবাবুর ব্যাখ্যা অবশ্য জানা যায়নি। রাত পর্যন্ত তাঁর সাড়া মেলেনি। রয়ে যাচ্ছে শুধু ইলিয়াসের আক্ষেপ আর পার্থবাবুর ছোট্ট প্রতিক্রিয়া, ‘‘মনে আছে সব!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy