যাদবপুরের পর লোকসভা। ফের দলের নির্দেশ অমান্য করার অভিযোগ উঠল তৃণমূলের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায়ের বিরুদ্ধে। শুধু তা-ই নয়, এ নিয়ে দলেরই অন্যতম নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনকে কার্যত চ্যালেঞ্জও ছুড়েছেন তিনি!
দেশে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, অথচ বাজেট অধিবেশনের শুরুতে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় তার কোনও উল্লেখই নেই— এই যুক্তিতে আজ লোকসভায় রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার ধন্যবাদজ্ঞাপন প্রস্তাবে সংশোধনী আনেন সৌগতবাবু। লোকসভায় বিজেপির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জেরে সেই সংশোধনী ভোটাভুটিতে খারিজ হয়ে গেলেও দমদমের সাংসদের এ হেন কাণ্ডে তৃণমূলের অন্দরে ফের আলোড়ন তৈরি হয়েছে। রাজ্যসভায় তৃণমূলের নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনের কথায়, ‘‘আরও একবার সৌগতবাবু পার্টির নির্দেশ ভাঙলেন!’’
দলের নির্দেশ কী? লোকসভায় তৃণমূলের নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজ্যসভার নেতা ডেরেকের বক্তব্য, তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ হল, রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় কোনও সংশোধনী আনা যাবে না। তাতে রাষ্ট্রপতির প্রতি অসৌজন্য দেখানো হয়। ডেরেক যা বলেছেন, তা উড়িয়ে সৌগতবাবুর মন্তব্য, ‘‘লোকসভার কাজকর্মে রাজ্যসভার নেতা ডেরেকের কথা বলা ঠিক নয়। লোকসভায় আমি কী করব, তা আমার ওনার থেকে শোনারও কথা নয়।’’
রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় অসহিষ্ণুতা, রোহিত ভেমুলা বা জেএনইউ প্রসঙ্গ না থাকা নিয়ে রাজ্যসভায় মোদী সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলতে জোট বাঁধছে সিপিএম ও কংগ্রেস। গত বছরের মতো এ বারও রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার ধন্যবাদজ্ঞাপন প্রস্তাবে সংশোধনী আনছে সিপিএম। সেখানে কংগ্রেস-সহ একাধিক বিরোধী দল তাদের সমর্থন করবে। রাজ্যসভায় বিরোধীদের সংখ্যা বেশি বলেই এই সুযোগ নিতে চাইছে সিপিএম। গত বছরও রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার ধন্যবাদজ্ঞাপন প্রস্তাবে দুর্নীতি দমন ও বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকা ফেরানোর ব্যাপারে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে সংশোধনী পাশ করিয়েছিল সিপিএম। এ বার সীতারাম ইয়েচুরি, ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, কে এন বালগোপাল মিলে ৬৯টি সংশোধনী এনেছেন। তাঁদের যুক্তি, রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা কেন্দ্রীয় সরকারই তৈরি করে দেয়। তাই এতে অপ্রিয় প্রসঙ্গ নেই।
একই সঙ্গে তৃণমূলকেও ফাঁদে ফেলতে চায় সিপিএম। কারণ তারা জানে, রাজ্যসভায় তৃণমূল এই ধরনের কোনও সংশোধনী আনবে না। এমনকী সিপিএমের আনা সংশোধনীতে কংগ্রেস বা অন্য বিরোধী দল সমর্থন করলেও তৃণমূল সে পথে হাঁটবে না। আর এটা নিয়েই তৃণমূল-বিজেপি আঁতাতের অভিযোগ তুলতে চায় সিপিএম। তাদের বক্তব্য হবে, বিধানসভা ভোটের আগে মোদী সরকার সম্পর্কে নরম সুর তৃণমূলের।
সিপিএমের পরিকল্পনা জেনেও রাজ্যসভায় রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় কোনও সংশোধনীতে সমর্থনে নারাজ তৃণমূল। অথচ লোকসভায় তার উল্টো কাজটাই করেছেন সৌগতবাবু! যা শুনে ডেরেক বলেন, ‘‘এ বিষয়ে পার্টির অবস্থান হল, সৌজন্যের খাতিরে দেশের রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় কোনও সংশোধনী আনা চলবে না। এ’টি দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষিত নির্দেশ। দলের সব সাংসদেরই তা জানার কথা।’’
সৌগতর পাল্টা যুক্তি, ‘‘এটা যে দলের লাইন, তা আমাকে লিখিত বা মৌখিক ভাবে জানানো হয়নি। সাত দিন আগে সংশোধনী জমা দিয়েছি। তা ছেপে বিলিও হয়েছে। লোকসভার নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বা মুখ্য সচেতক কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় কেউ কিছু বলেননি। আজ আমি যখন সংশোধনী আনি, তখন ওঁরা ছিলেন না। তখন উপস্থিত সুগত বসু-ইদ্রিশ আলিদের সঙ্গে আলোচনা করেই করেছি।’’ সৌগতর ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, আজ প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় সৌগতবাবুর নাম করেছেন। বিষয়টি ডেরেকের চক্ষুশূল হয়েছে। ঈর্ষাজনিত কারণেই ডেরেক লোকসভা নিয়ে মাথা গলিয়েছেন। সিপিএমের ফাঁদে পা না দিতে সৌগতর কৌশল সঠিক বলেও তাঁর ঘনিষ্ঠদের যুক্তি। কারণ অন্যরা যখন সংশোধনী আনবে, তখন সমর্থন করা না করার প্রশ্ন আসবে। নিজেরাই সংশোধনী আনলে সেই সমস্যা নেই।
জেএনইউ-কাণ্ডে দীর্ঘদিন নীরব থাকার পর সুগত বসু যখন লোকসভায় মোদী সরকারকে আক্রমণ করেন, তখনও প্রশ্ন উঠেছিল, এটা কি পার্টি লাইনের বিরোধিতা নয়? সে দিন পর্যন্ত ঘোষিত দলীয় নীতি ছিল, জেএনইউ-কাণ্ডে এখনই কোনও অবস্থান নেওয়া হবে না। সুগতবাবুর বক্তৃতার আগেই যাদবপুর নিয়ে মুখ খুলে তিরস্কৃত হয়েছিলেন সৌগত। এ ক্ষেত্রে দলের ব্যাখ্যা ছিল, এই দু’টির মধ্যে ফারাক রয়েছে। সুগত যা করেছেন, দলের নির্দেশ মেনেই করেছেন। সৌগত বলেছেন নিজের মর্জিমাফিক। মমতার সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করেননি।
যাদবপুরে যে ছাত্ররা দেশ-বিরোধী স্লোগান দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ, তাঁদের বিরুদ্ধে উপাচার্য পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেননি। সৌগতবাবু যাদবপুরের উপাচার্য সুরঞ্জন দাসের ভূমিকাকে সমর্থন করেছিলেন। তার পরেই তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, সৌগতর বক্তব্য দলের বক্তব্য নয়। দলের বাইরে মুখ খুলে তিনি দলনেত্রীর নির্দেশ অমান্য করেছেন। এর আগে রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভুর প্রশংসা করেও দলের তোপের মুখে পড়েন সৌগত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy