দেবরাজের (ডান দিকে ফাইল চিত্র) জয়ের পর তাঁর সঙ্গে দেখা করে দমদম সেন্ট্রাল জেল থেকে বেরিয়ে আসছেন বাবা তরুণ চক্রবর্তী (সামনের সারিতে ডান দিকে)। শনিবার। — নিজস্ব চিত্র।
গরাদের ও পাশে ছেলে, এ পাশে বাবা। দু’জনের চোখেই জল। আনন্দের। ঠোঁটে তর্জনি ঠেকিয়ে ছেলে বাবাকে বললেন, ‘‘এখন উচ্ছ্বাস নয়!’’
কস্মিন কালেও এমন দৃশ্য দেখেননি দমদম সেন্ট্রাল জেলের আপাত কঠিন কারারক্ষীরা। জেলের সমস্ত টিভিতে তখন আগের রাতে আসা ‘নতুন অতিথি’র ছবি। সবে মাত্র যিনি বিধাননগর পুর-নিগমের ভোটে তৃণমূলকে হারিয়ে জিতেছেন— কংগ্রেসের দেবরাজ চক্রবর্তী।
ক’দিন বাদেই দুর্গাপুজো। জেলেও হয় ফি-বছর। মূর্তি এসে গিয়েছে, আলোয় সাজছে জেল। মনখারাপের ধারাবাহিক আবহের মধ্যেও একটা খুশি-খুশি ভাব। তার মাত্রা চড়ল ‘কচি ছেলেটা’র জয়ে। ফলে বন্দিদের কারও সঙ্গে দেবরাজের করমর্দন, কারও সঙ্গে আলিঙ্গন পর্ব চলল কিছু ক্ষণ।
শনিবার সকালে একটির পর একটি বুথের ফল প্রকাশের পর ব্যবধান যখন বাড়ছে, আর নিজেকে স্থির রাখতে পারেননি দেবরাজের বাবা তরুণ চক্রবর্তী। ভাই তাপস আর দেবরাজের বন্ধু রেশমিকে নিয়ে তিনি চলে যান দমদম জেলে। সেখানে দাঁড়িয়ে বাবা বলেন, ‘‘কত অচেনা বহিরাগতের বোমা, গুলির বিরুদ্ধে মাথা ঠান্ডা রেখে জিতেছে ছেলে। এ মানুষের জয়, সত্যের জয়।’’ রেশমির কথায়, ‘‘ওর জয়ে গোটা রাজারহাট খুশি হলেও সবাই কাঁদছে। দু’দিন পরে ও ছাড়া পেলেই হবে আনন্দ উৎসব।’’
বিধাননগর পুর-নিগমের ভোটে শাসক দলের আনা হামলার অভিযোগে শুক্রবার থেকে দমদম সেন্ট্রাল জেলে রয়েছেন দেবরাজ। জয়ের খবর পেয়েই দেবরাজের সঙ্গে এ দিন জেলে দেখা করতে যান কংগ্রেসের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি তাপস মজুমদার। তিনি বলেন, ‘‘যে ভাবে ও শাসক দলের গুন্ডাবাহিনীকে ঠেকিয়ে জিতল, তাতে দেবরাজকেই আমাদের দলের নতুন প্রজন্মের মুখ করা হবে।’’ দেবরাজের গ্রেফতারির খবর পেয়ে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূলের দৈত্যকুলে কংগ্রেসের প্রহ্লাদ হল দেবরাজ। তাকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়েই তৃণমূল নেতৃত্ব নৈতিক পরাজয় স্বীকার করেছেন। তৃণমূলই বুঝিয়ে দিয়েছে, দেবরাজ তাদের মাথাব্যথার কারণ।’’
এলাকার মানুষেরও একই কথা। মাসখানেক আগেও এলাকায় তৃণমূলের মুখ বলতে সবাই রাজারহাটের বিধায়ক, কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর আপ্ত সহায়ক এবং সাংসদ দোলা সেনের ঘনিষ্ঠ দেবরাজকেই চিনত। জন্মের শংসাপত্রের ব্যবস্থা থেকে শুরু করে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা— যে কোনও প্রয়োজনে এলাকার মানুষ যেতেন দেবরাজের কাছেই। দলমত নির্বিশেষে সাহায্য পেতেন। এই সূত্রেই কৈখালি, মণ্ডলগাঁতির মানুষের সঙ্গে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ গড়ে ওঠে।
তা হলে দেবরাজ কংগ্রেসের প্রার্থী হলেন কী ভাবে? স্থানীয়রা জানান, প্রতিশ্রুতি দিয়েও এ বারের নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত দেবরাজকে প্রার্থী করেনি তৃণমূল। তারই জেরে কংগ্রেসের হয়ে ভোটের লড়াইতে নামেন এই তরুণ। অবশ্য সে জন্য খেসারতও কম দিতে হয়নি। ভোটের দিন তাঁকে মারধর করে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। রাতে ছেড়েও দেয়। কিন্তু পরের দিনই দক্ষিণ দমদমের এক তৃণমূল কাউন্সিলরকে মারধরের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় দেবরাজকে।
থানায় বসেই দেবরাজ এসএমএস পাঠান পূর্ণেন্দুকে— ‘জেঠু, আমি অ্যারেস্ট হলাম। ভুল কিছু করিনি। তা-ও হলাম। আমি কাল প্রেসকে সব বলব তোমার আর দোলাদির ব্যাপারে। এত নীচে নামবে আমি জানতাম না। থ্যাঙ্ক ইউ।’
সংবাদমাধ্যমকে কী বলতে চেয়েছিলেন দেবরাজ? এলাকার মানুষদের কারও কারও মতে, দীর্ঘদিন ধরে মন্ত্রী ও সাংসদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে রাজারহাট-নিউটাউন অঞ্চলের সিন্ডিকেট রাজের অনেক অনিয়মের খবরই হয়তো দেবরাজ জানেন। এই সব চক্রের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের একাংশের যোগাযোগের কানাঘুষো প্রায়ই শোনা যায়। হতে পারে, তেমন কোনও খবরই সংবাদমাধ্যমকে জানানোর কথা বলেছিলেন দেবরাজ। অনেকে এ-ও বলছেন, দল টিকিট না দেওয়ায় দেবরাজ দল পাল্টেছিলেন ঠিকই। কিন্তু তার জন্য এত হেনস্থা হতে হবে, ভাবতে পারেননি এই তরুণ। চূড়ান্ত অভিমানেই তিনি ‘জেঠুকে’ এসএমএস করেন। আর পূর্ণেন্দুও সে দিন বলেছিলেন, ‘‘ওর বয়স কম। রাগের মাথায় এ সব করছে।’’ এ দিন অবশ্য ‘কিছু বলার নেই’ বলেই ফোন কেটে দিয়েছেন পূর্ণেন্দু। আর সাংসদ দোলা সেন দলের হারের দায় চাপাতে চেয়েছেন উচ্চতর নেতৃত্বের ঘাড়ে। বলেছেন, ‘‘বিধাননগর ভোটে দায়িত্বে তো আমি ছিলাম না।’’
বিধাননগরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে দেবরাজ জিতেছেন ৩১২ ভোটের ব্যবধানে। আর পূর্ণেন্দু-দোলার এই খাসতালুকে তৃণমূলের প্রার্থী খুরশিদ আলম নেমে গিয়েছেন তৃতীয় স্থানে! খুরশিদের স্ত্রী পারভিন খুরশিদ এলাকার বিদায়ী বোর্ডে তৃণমূলের কাউন্সিলর ছিলেন। হার নিয়ে কিছু বলতে চাননি তৃণমূল প্রার্থী। যদিও বিরোধীদের দাবি, এই হার আসলে স্থানীয় বিধায়ক পূর্ণেন্দুরই। এক বাসিন্দা জানালেন, তৃণমূলের প্রার্থী বাছাই নিয়ে ক্ষোভ ছিল এলাকায়। তৃণমূল জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও স্বীকার করেছেন, ৭ নম্বর ওয়ার্ডে সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল।
সঙ্গে যোগ হয় দেবরাজকে হারাতে কৈখালি এলাকায় ঢুকে তৃণমূলের বহিরাগতদের শাসানি-ধমকানি। তাদের এই দাপাদাপি পছন্দ করেননি ওয়ার্ডের মানুষ। যে কারণে, ভোটের দিন যখনই হামলা হয়েছে, ভোটারদের পাশে নিয়ে তা রুখে দিতে পেরেছিলেন কংগ্রেস কর্মীরা। দেবরাজের জয়ের এটাও বড় কারণ বলে মনে করছেন অনেকেই। এবং থেকে থেকেই মাথাচাড়া দিয়েছে একটা প্রশ্ন— যাঁকে নিগ্রহের দায়ে দেবরাজ এখন জেলে, দক্ষিণ দমদমের সেই তৃণমূল কাউন্সিলর ভোটের দিন কৈখালিতে কী করছিলেন?
দেবরাজের অবশ্য কোনও যুক্তি-তর্কেই এখন আর কিছু যায়-আসে না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy