সরব: প্রবাসে বন্ধুদের সঙ্গে নতুন নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদ করার ছবি দেখাচ্ছেন কৌস্তভ চট্টোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র
গায়ে হাত তোলা, কলেজে ঢোকা তো দূরঅস্ত। তাঁদের বিদেশের আবাসন থেকে যদি কখনও শব্দ দূষণের অভিযোগ পেয়ে পুলিশ আসেও, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলে চলে যায়। সেখানে জেএনইউয়ের হস্টেলে একদল বহিরাগত ঢুকল কী করে?
সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছেন বছর ছাব্বিশের গবেষক। আর কয়েক দিন পরেই ছুটি শেষে ফের বিদেশে নিজের কলেজে ফিরে যাওয়ার আগে তিনি বলেন, ‘‘আমি মর্মাহত। এটাই কি আমাদের দেশ?’’
কামারহাটির ঠাকুরদাস চ্যাটার্জি রোডের বাসিন্দা কৌস্তভ চট্টোপাধ্যায়। বাড়ির কিছুটা দূরেই সংখ্যালঘুদের বসবাসের জায়গা। ছেলেবেলায় সেই মহল্লায় বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে ক্রিকেট, ফুটবল খেলেছেন। এমনকি দুর্গাপুজোয় কৌস্তভদের বাড়িতেও একসঙ্গে পাত পেড়ে খাওয়াদাওয়া করেন পড়শি মহল্লার লোকজন। আমেরিকায় বসে আজও ইদে মুসলিম বন্ধুর বাড়ির বিরিয়ানির কথা মনে করেন সেখানকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কৌস্তভ। তবে বছর দেড়েক ধরে কলেজেই মুসলিম বন্ধুর হাতে বানানো বিরিয়ানি চেটেপুটে খান কামারহাটির ওই যুবক ও তাঁর সঙ্গীরা। কারণ তাঁরা সকলে মনে করেন, তাঁদের পরিচয় একটাই, ‘ভারতীয়’।
জাত-ধর্মের বিভাজন নয়। শুধু ভারতীয় পরিচয়টাই ধরে রাখতে বিদেশের মাটিতেও নতুন নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন কৌস্তভ ও তাঁর প্রবাসী বন্ধুরা। তাঁদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়েছেন আমেরিকার ভূমিপুত্র পড়ুয়াদের একাংশও। কৌস্তভ বলেন, ‘‘জানেন, আমাদের জার্মান বন্ধুরা সব সময়ে বলছেন, ‘এখনই যদি তোমরা, ভারতীয়েরা রুখে না দাঁড়াও, তা হলে পরবর্তী প্রজন্ম তোমাদের ক্ষমা করবে না।’’ যেমন জেএনইউয়ে ঐশী ঘোষের উপরে যাঁরা আক্রমণ করেছেন তাঁদেরও ক্ষমা করা যায় না বলেই মনে করেন ওই গবেষক।
নতুন নাগরিকত্ব আইন যে দিন দিল্লির সংসদে পাশ হল, সে দিন রাত জেগে টিভিতে তা দেখেছেন কৌস্তভের মতো ব্লুমিংটন শহরে থাকা অন্য প্রবাসী পড়ুয়ারা। সব দেখেশুনে রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল তাঁদের। ভারতীয় রাজনীতি নিয়ে প্রতিনিয়ত ওয়াকিবহাল থাকা সেই পড়ুয়ারা পরের দিন কলেজে গিয়েই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নেমে পড়েছেন রাস্তায়। নেতৃত্বে ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় ছাত্রদের সংগঠন। ৫০০-র বেশি পড়ুয়া পড়াশোনা করে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে। কৌস্তভ বলেন, ‘‘গোটা আমেরিকা মিলিয়ে প্রায় ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ হয়েছে। বার্লিন, বস্টন, ওয়াশিংটন ডিসি, টরন্টো, শিকাগো, সান ফ্রান্সিসকো-সহ বিভিন্ন জায়গায় বিরোধিতায় সামিল হয়েছেন পড়ুয়ারা।’’
সংবাদপত্রের পাতায় ঐশীর রক্তাক্ত ছবিটা দেখে অস্ফুট স্বরে কৌস্তভ বললেন, ‘‘এ ভাবে কাউকে বাকরুদ্ধ করা যায় না। আমাদের কলেজেও এর প্রতিবাদ হবে।’’ কামারহাটিতে বসেই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে গবেষক তরুণ জেনেছেন, প্রতিবাদ হবে সেখানেও। যেমন ভাবে নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় নিজেদের হাতে লেখা পোস্টার নিয়ে নীরব ভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেছেন কলেজ চত্বরে কিংবা সামনের রাস্তায়। পথ চলতি স্থানীয়েরাও অনেক সময়ে ‘হোয়াট ইজ দিস’ প্রশ্ন তুলে এগিয়ে এসে, সব শুনে বুঝে কিছু ক্ষণের জন্য দাঁড়িয়েছেন পড়ুয়াদের পাশে।
অগস্টে ছুটির আবেদন করার সময়ে দেশে ফেরার একরাশ আনন্দ ছিল বাঙালি গবেষকের। কিন্তু বড়দিনের দিন যখন তিনি দেশের মাটি ছুঁলেন, তখন নয়া নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে উত্তাল পরিস্থিতি। পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান বাবার নেতৃত্বে নাগরিকত্ব আইন বিরোধিতার মিছিলে হেঁটেছেন কৌস্তভ। তবে তাঁর কথায়, ‘‘রাজনীতি বুঝি না। শুধু জানি, দেশকে বাঁচাতে সকলের একজোটে পথে নামা উচিত।’’
ছুটি শেষের মুখে। যে সব বিদেশি বন্ধুরা উপহার নিয়ে যেতে বলেছিলেন, তাঁরা এখন জানতে চাইছেন, কৌস্তভের শহর-রাজ্য-দেশে ঠিক কী চলছে। ফিরে যাওয়ার পরেও আসবে সেই প্রশ্ন। কৌস্তভ বলছেন, ‘‘কী বলব জানি না। শুধু জানি মর্মাহত হৃদয়ে দেশ ছাড়ব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy