এক বার নয়। গত শুক্রবার রাতে ঘণ্টা দুয়েকের ব্যবধানে দক্ষিণ কলকাতার একই তল্লাটে দু-দু’বার পথ-বিধি ভেঙেছিল তাঁর গাড়ি। তৈরি হয়েছিল বড় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা। কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ভাইঝি দেবপ্রিয়ার বিরুদ্ধে তার জন্য কোনও ব্যবস্থা নেওয়া তো হয়ইনি, উল্টে জনরোষের হাত থেকে তাঁকে স-সঙ্গী উদ্ধার করে থানায় নিয়ে এসেছিলেন যাঁরা, সেই পুলিশকর্মীদের সঙ্গেও তিনি চরম দুর্ব্যবহার করেন বলে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রের দাবি।
এবং পুলিশের নিচুতলার এ-ও আক্ষেপ, থানায় বসে সরকারি কাজে বাধাদানের মতো গুরুতর অপরাধ করা সত্ত্বেও ওঁদের যে ভাবে রেহাই দেওয়া হচ্ছে, তাতে আইনরক্ষকের ভাবমূর্তি ধুলোয় লুটিয়েছে। সর্বোপরি স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টিকে ‘বাচ্চা মেয়েদের কাজ’ হিসেবে অভিহিত করায় অনেকেই হতাশা লুকোতে পারছেন না।
একই সঙ্গে লালবাজারের শীর্ষ মহলকে পাশে না-পাওয়ায় নিচুতলা আরও হতোদ্যম। বিষয়টি নিয়ে কলকাতা পুলিশের কোনও কর্তাই ‘সরকারি ভাবে’ মুখ খুলতে নারাজ। ভারপ্রাপ্ত যুগ্ম কমিশনার (সদর) সুপ্রতিম সরকার মন্তব্য করতে চাননি। আর পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থের অফিস থেকে বলা হয়, সিপি ২৬শে জুলাই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে লন্ডন যাবেন, তারই প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন।
পুলিশ-সূত্রে জানা যাচ্ছে, শুক্রবার রাতে দেবপ্রিয়ার গাড়ি প্রথম বার বিধিভঙ্গ করে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের মোড় থেকে চেতলার দিকে ঘোরার সময়। তখন সিগন্যাল ছিল লাল, মোড়ের সিসিটিভি ফুটেজেও তার প্রমাণ মজুত। সিগন্যাল অমান্যের পাশাপাশি সেখানে এক পথচারীকে ধাক্কা মারার উপক্রম করেছিল গাড়িটি। ঘণ্টা দেড়েক বাদে ওই গাড়িই নেপাল ভট্টাচার্য স্ট্রিটের উল্টো দিকে ডিভাইডারে উঠে পড়ে। লালবাজারের একাধিক সূত্রের দাবি, দু’বারই লোকজন জড়ো হয়ে যাওয়ায় পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল।
টালিগঞ্জ ট্র্যাফিক গার্ডের অভ্যন্তরীন তদন্তে একই তথ্য বেরিয়ে আসছে। ট্র্যাফিক-সূত্রের বক্তব্য: প্রথম ঘটনাটি সম্পর্কে কনস্টেবল চন্দন পাণ্ডে ‘সাইটেশন রিপোর্ট’ও করেছিলেন। অর্থাৎ, গাড়ির নম্বর দিয়ে সিগন্যাল ভাঙার ঘটনা জানিয়েছিলেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। যার ভিত্তিতে পরে গাড়ি-মালিকের থেকে একশো টাকা জরিমানা আদায় করার কথা। ঠিক কী হয়েছিল?
প্রত্যক্ষদর্শী ও টালিগঞ্জ ট্র্যাফিক গার্ডের অনেকে জানিয়েছেন, দেবপ্রিয়ার গাড়ি সিগন্যাল ভেঙে চেতলার দিকে ঘুরতে গিয়ে এক পথচারীর প্রায় গায়ের উপরে উঠে পড়ে। চেঁচামেচি শুনে রাসবিহারী মোড়ে ডিউটিরত চন্দনবাবু গাড়ি আটকে দেবপ্রিয়ার লাইসেন্স দেখতে চান। অভিযোগ, দেবপ্রিয়া তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। এমনকী, চন্দনবাবুর নোটবই কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়, যেখানে তিনি গাড়ির নম্বর টুকে নিয়েছিলেন। লোকজন জড়ো হয়ে যায়। পোঁছে যায় বাড়তি পুলিশ। অভিযোগ, নিজেকে মেয়রের ভাইঝি হিসেবে পরিচয় দিয়ে তাঁদের সঙ্গেও বচসায় জড়িয়ে পড়েন দেবপ্রিয়া।
তার পরেও কিন্তু দেবপ্রিয়া ও তাঁর দুই বান্ধবীকে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়নি। গাড়ির আরোহী দুই যুবককে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়, মেয়েদের
বলা হয় বাড়ি চলে যেতে। ফেরার পথেই গাড়ি ডিভাইডারে তুলে দেন মেয়রের ভাইঝি!
একই গাড়ি ঘিরে ফের চাঞ্চল্য ছড়ায়। লালবাজারের খবর, এ বার স্থানীয় লোকজন গাড়িটি ঘিরে ফেলেছিল। পুলিশ না-গেলে তিন তরুণীকে হেনস্থাও করা হতে পারত। পরিস্থিতি সামাল দিতে ওঁদের টালিগঞ্জ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ওঁরা সেখানেও পুলিশের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ।
এমতাবস্থায় ‘পুলিশের কাজে বাধাদান’ ও ‘এলাকায় উত্তেজনা ছড়ানোর’ জন্য ভারতীয় দণ্ডবিধির দু’টি ধারায় দেবপ্রিয়াদের নামে অভিযোগ রুজু করেন টালিগঞ্জ থানার সাব ইন্সপেক্টর এ কে মিশ্র। প্রথম ধারাটি জামিন-অযোগ্য। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন, এমন এক পুলিশকর্মীর কথায়, ‘‘পাবলিক ওঁদের ব্যাপার-স্যাপার দেখে ক্রমশ খেপে উঠছিল। বিশেষত মেয়রের ভাইঝি এমন সব বাক্য প্রয়োগ করছিলেন, যাতে গণ্ডগোল বেধে যেতে পারত।’’
কেন?
এক প্রত্যক্ষদর্শীর দাবি, মেয়রের সঙ্গে আত্মীয়তার ঘোষণা তো বটেই, খোদ মুখ্যমন্ত্রীর নামও করা হচ্ছিল। ‘‘উনি (দেবপ্রিয়া) বলছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওঁর বাড়িতে খেতে আসেন। পুলিশ ওঁর কী করবে?’’— জানাচ্ছেন এক পুলিশকর্মী। তিনি বলেন, ‘‘বিস্তর তৃণমূল-সমর্থক ওখানে ছিলেন। দুর্ঘটনা ঘটিয়ে, পুলিশকে গালিগালাজ করে আবার মুখ্যমন্ত্রীর নাম তোলায় তাঁরা খেপে উঠেছিলেন। আমরা ওঁদের বুঝিয়ে-সুজিয়ে মেয়ে তিনটিকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসি।’’
এর প্রশংসা তো দূর, উল্টে আইনরক্ষকের ‘ভাবমূর্তি’ নষ্ট করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী ওঁদেরই দায়ী করায় কলকাতা পুলিশের নিচুতলা হতাশ। দক্ষিণ ডিভিশনের এক গুরুত্বপূর্ণ থানায় কর্মরত এক কনস্টেবলের খেদ, ‘‘বারবার মার খেয়ে দেওয়ালে আমাদের পিঠ ঠেকে গিয়েছে। কোন ভরসায় কাজ করব?’’
লালবাজারে কর্মরত এক জনের পর্যবেক্ষণ, ‘‘এমনিতেই মানুষ ভাবছে, আমাদের মেরুদণ্ড নেই। আত্মীয়-বন্ধুদের কাছে মুখ দেখানো দায়। এ বার বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য আমাদের আত্মবিশ্বাস একেবারে ধসিয়ে দিল!’’
বেহালা ডিভিশনের এক এসআই জানান, শুধু মে মাসেই রাজ্যে পুলিশ নিগ্রহের দশটি ঘটনা ঘটেছে, কোথাও নিগৃহীতেরা প্রতিকার পাননি।
উত্তর ডিভিশনের একাধিক কনস্টেবল বলেন, আলিপুর থানায় হামলা চালিয়ে, গোপালনগর মোড়ে পুলিশ পিটিয়ে প্রতাপ সাহারা বুক ফুলিয়ে ঘুরছেন, আর কর্তব্য পালন করতে গিয়ে পুলিশকে ছুটি নিয়ে মুখ লুকোতে হচ্ছে!
‘‘উপরন্তু পুলিশকে জুতো বওয়ানো বা জুতো পরানোর কাজে লাগাচ্ছেন মন্ত্রীরা। আমাদের মানসম্মান আর কী রইল?’’— প্রশ্ন ওঁদের প্রায় সকলেরই।
বস্তুত, চন্দন পাণ্ডে লম্বা ছুটি নিয়ে দেশের বাড়ি পাড়ি দেওয়ায়
যে প্রশ্নটা প্রকট হয়েছে, তা হল: মেয়রের ভাইঝির নিয়মভঙ্গের প্রতিবাদ করার মাসুল দিতেই কি ওঁকে ছুটিতে পাঠানো হল?
যা শুনে ডিসি (ট্র্যাফিক) ভি সলোমন নেসাকুমারের দাবি, ‘‘কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হয়নি। চন্দনবাবু আগেই ছুটির দরখাস্ত করেছিলেন, তা মঞ্জুর হয়েছে।’’ যদিও লালবাজারের অন্দরমহলের খবর: এক লপ্তে লম্বা ছুটি সাধারণত মেলে না বললেই চলে। ছুটি পাওয়া নিয়ে পুলিশের ভিতরে ক্ষোভও কম নয়।
চন্দন পাণ্ডের দীর্ঘ ছুটিপ্রাপ্তি ঘিরে ধন্দ তাই থেকেই যাচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy