ফাইল চিত্র।
প্রায়ই কলকাতায় যেতেন রঞ্জন। এমনি সময়ে এলাকায় স্কুটি নিয়ে ঘুরলেও সে সময়ে গাড়িতে যেতেন। সঙ্গে থাকতেন বিশ্বস্ত কয়েক জন। সেই গাড়ির ডিকিতে প্রায়শই বস্তা তুলতে দেখেছেন গ্রামের লোক। কলকাতায় যাওয়ার সময়ে পথে নাকি একাধিক বার গাড়ি বদলাতেন রঞ্জন। অনেকেরই প্রশ্ন, চাকুরিপ্রার্থীদের কাঁচা টাকা কি এ ভাবেই পাচার হত? কলকাতায় যাওয়ার সময়ে তাঁকে ফলমূল কিনতে দেখেছেন এলাকার লোকজন। এক জন বললেন, ‘‘অফ সিজনে ৩০০ টাকা কেজি দরে কিলো কিলো আমও কিনতে দেখেছি ওঁকে!’’ স্থানীয় অনেকেরই ধারণা, টাকা একা ভোগ করতেন না রঞ্জন। এলাকায় তিনি বলতেন, তাঁর হাত অনেক লম্বা। রাজ্যের কোনও এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর তিনি আত্মীয়— এমনও দাবিও করতে শোনা গিয়েছে রঞ্জনকে। শুরুতে একাই কাজ করতেন। পরে এজেন্ট ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়।
নিজের জীবন অবশ্য ছিল অনাড়ম্বর। দোতলা বাড়িতে কোনও বাহুল্যের ছাপ নেই। দুই মেয়ের এক জনের বিয়েতেও সে ভাবে টাকা ছড়াতে দেখা যায়নি। নিমন্ত্রিতের তালিকায় কোনও কেষ্টবিষ্টুও ছিলেন না বলে জানালেন স্থানীয় মানুষ।
কিন্তু ইদানীং যে রঞ্জনের প্রভাব কমছিল, তা জানা গেল এলাকায় কথা বলে। এক মহিলা তাঁর মেয়ের স্কুলে চাকরির জন্য ৮ লক্ষ টাকা দিয়েছেন রঞ্জনকে। তাঁর কথায়, ‘‘চাকরি-বাকরি নিয়ে যা মামলা-মোকদ্দমা, তদন্ত হচ্ছে, তাতে আর মেয়ের চাকরিটা হল বলে মনে হচ্ছে না। এখন টাকাটা ফেরত পেলে বাঁচি। উনি বলেছেন, টাকা ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু একটু সময় লাগবে।’’ গত কয়েক মাসে নতুন করে কাউকে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে টাকা নিতে শোনা যায়নি রঞ্জনকে। বরং দিন সাতেক আগে বাড়ির সামনে বেশ কিছু যুবক ভিড় করেন টাকা ফেরতের দাবিতে। এঁরা সকলেই স্কুলে চাকরির জন্য রঞ্জনকে কয়েক লক্ষ করে টাকা দিয়ে বসে আছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেল। এত দিন যাঁর সম্পর্কে শোনা যেত, টাকা দিয়ে কেউ খালি হাতে ফেরেনি— সেই রঞ্জনই নাকি এ বার জানিয়েছেন, সকলকে টাকা ফেরত দেবেন। একটু সময় লাগবে। এ-ও জানিয়েছেন, আপাতত টাকার বিনিময়ে কাউকে চাকরি করে দিতে পারবেন না। সে দিন তাঁর বাড়ির সামনে ওই জমায়েতের পর থেকেই রঞ্জনকে আর বাড়িতে দেখা যাচ্ছে না বলে জানালেন পাড়া-পড়শিরা। দোতলা বাড়ির দরজা বাইরে থেকে তালা ঝোলানো। আশপাশের কেউ ফোন নম্বর দিতে রাজি হলেন না।
রঞ্জনকে টাকা দিয়ে চাকরি হয়েছে, এমন অনেকেই আছেন এলাকায়। গ্রামের লোকেরা তাঁদের চেনেন-জানেন। এমন এক জনের সঙ্গে কথা বলতে গেলে মুখের উপরেই দরজা বন্ধ করে দিলেন। আর এক জন দাবি করলেন, রঞ্জনকে চেনেনই না। অনেকেরই ভয়, প্যানেল বাতিল হয়ে চাকরি সঙ্কটে পড়বে না তো!
এমন ‘আতঙ্কের’ সময় অবশ্য আগে ছিল না। এক সময়ে সত্যিই বলে বলে রঞ্জন চাকরি দিয়েছেন লোককে— সে কথাই বেশি ঘোরে মানুষের মুখে। জানা গেল, এক বার প্রাথমিকে চাকরির প্রথম তালিকায় নাম বেরোয়নি অনেকের। এঁরা সকলেই টাকা দিয়েছিলেন রঞ্জনকে। সকলে ধর্না দেন রঞ্জনের বাড়িতে। ওয়েবসাইটে তাঁদের নামের পাশে ‘নট কোয়ালিফায়েড’ লেখা। রঞ্জন সকলকে আশ্বস্ত করেন। বিকেলের দিকে যে তালিকা প্রকাশিত হয় ওয়েবসাইটে, সেখানে সকলের নামের পাশে ‘কোয়ালিফায়েড’ লেখা ছিল।
এক যুবক আবার বললেন, ‘‘আমার প্যানেলে নাম ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই চাকরি হয়েছিল। তবে উনি আমার থেকেও কয়েক লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন। পরে শুনেছি, প্যানেলে নাম আছে জেনে নিয়ে অনেকের থেকে টাকা তুলেছেন রঞ্জনবাবু।’’ স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ জানাচ্ছেন, ডিএলডি শংসাপত্রও টাকার বিনিময়ে পাইয়ে দিতেন রঞ্জন। প্রাথমিকে চাকরি পেতে এই শংসাপত্র লাগত। শংসাপত্র দিতে রঞ্জন নিতেন ১ লক্ষ টাকা। পরিচিতের মাধ্যমে এলে ‘ডিসকাউন্ট’ মিলত। ৬০ হাজার টাকায় রফা হত।
স্থানীয় এক যুবক আবার জানালেন, তাঁর ২০ হাজার টাকা জলে গিয়েছে। যুবকের কথায়, ‘‘এক বছর আগে ডিএলডি শংসাপত্র পেতে রঞ্জনের কাছে গিয়েছিলাম। কথা ছিল, আমাকে প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিতে হবে না। শংসাপত্রও পেয়ে যাব। রঞ্জনকে ২০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে আমাকে কলেজে ভর্তি হয়ে ফি জমা দিয়ে দু’টো পরীক্ষা দিতে হয়েছে। ২০২১ সালে প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছি। ২০২২ সালে দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছি। রেজাল্ট সামনে বের হবে। রঞ্জন শংসাপত্র দিতে পারেননি। আমার টাকা জলে গিয়েছে।’’ এলাকার এক বাসিন্দা আবার জানালেন, ২০১৭ সালে উচ্চ প্রাথমিকে এক প্রতিবন্ধী যুবক চাকরি পান। রঞ্জনের সঙ্গে ৮ লক্ষ টাকায় চুক্তি হয়েছিল। অগ্রিম দেন ৩ লক্ষ টাকা। চাকরি পাওয়ার পরে নাকি বাকি টাকা দেননি।
‘সৎ রঞ্জন’কেও এমন অসততার মুখোমুখি হতে হয়েছিল!
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy