কয়েক ঘণ্টা আগে অবধি যে বাড়িতে সাজানো সংসার ছিল, সেই বাড়ি থেকেই ধোঁওয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছিল আকাশে। পোড়া কটূ গন্ধে দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। বাইরে ছড়িয়ে ছিল জানলার ভাঙা কাচ। দমকল আগুন নেভানোর চেষ্টা করলেও ধোঁওয়া উঠেছে দুপুর অবধি।
বাড়ি থেকে জিনিসপত্র গুছিয়ে অন্য আশ্রয়ের পথে নিহত ভাদু শেখের পরিবার। রামপুরহাটের বগটুইয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।
জাতীয় সড়কের লাগোয়া। সেই সুবাদেই রামপুরহাটের বগটুই গ্রাম বেশ জমজমাট। সকাল হতে না হতেই লোক জমে চায়ের দোকানে। সোমবার রাত থেকে এলাকার সেই ছবিটা একেবারে বদলে গিয়েছে। তা টের পাওয়া গেল মঙ্গলবার সকালেও। মুখ খুলতেই চান না কেউ, এমনকি গ্রাম ছেড়েছেন অনেকেই।
সোমবার রাতে বগটুই মোড়ে উপপ্রধান ভাদু শেখের খুনের পর থেকেই বোমাবাজি শুরু হয় বগটুই গ্রামে। গ্রামের গোটা দশেক বাড়িতে আগুন লাগে। এ দিন সকালে গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, দু’জন পুলিশ কর্মী এলাকায় মোতায়েন। পুলিশ লোহার ব্যারিকেড ও ইট দিয়ে গ্রামের রাস্তা ঘিরে রেখেছে। স্থানীয় বাসিন্দারাও গ্রামে ঢুকতে মানা করছিলেন। সকাল ন’টার পরে বগটুই গ্রামের পূর্বপাড়ায় পৌঁছনো গেল। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় বাসিন্দা মনিরুল শেখের বাড়ির আগুন নেভাতে ব্যস্ত দমকল কর্মীরা। সেখানে কিছু বাসিন্দাকে জিজ্ঞাসা করতেই তাঁরা দেখিয়ে দিলেন সোনা শেখের বাড়ি। এই বাড়ি থেকেই মঙ্গলবার ভোরে উদ্ধার হয়েছে পুড়ে কাঠ হয়ে যাওয়া সাতটি দেহ। রাতে জ্বলা সেই আগুন সকালেও ধিকিধিকি জ্বলছিল। কয়েক ঘণ্টা আগে অবধি যে বাড়িতে সাজানো সংসার ছিল, সেই বাড়ি থেকেই ধোঁওয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছিল আকাশে। পোড়া কটূ গন্ধে দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। বাইরে ছড়িয়ে ছিল জানলার ভাঙা কাচ। দমকল আগুন নেভানোর চেষ্টা করলেও ধোঁওয়া উঠেছে দুপুর অবধি। পোড়া ঘরগুলিতে ঢুকে দেখা যায়, এমন ভাবে বাড়িতে আগুন ধরানো হয়েছে তাতে ভিতরের সমস্ত আসবাবই পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে গিয়েছে। টিভি, ফ্রিজ, মোটরবাইক— পুড়ে কাঠ সবই। বারান্দায় ঢুকে দেখা যায় দুপুরেও ঘরের পোড়া দেওয়াল থেকে আগুনের আঁচ বেরোচ্ছে। রাতের অন্ধকারে যে বাড়ি লক্ষ্য করে বোমা ছোড়া হয়েছিল তার চিহ্নও দেখা গিয়েছে সকালে।
পোড়া একটি বাড়ির সামনে পড়ে ছিল বোমার সুতলি। রাতভর ওই তাণ্ডবের পরে কার্যত কথা হারিয়েছে গোটা গ্রামই। পুড়ে যাওয়া বাড়ির আশপাশের বাড়িগুলি সবই ছিল তালাবন্ধ। গ্রামের যে সব বাড়িতে মানুষজন ছিলেন তাঁরাও গৃহবন্দি। গ্রামের যে হাতেগোনা কয়েক জনকে রাস্তা দেখা গিয়েছে তাঁদের দাবি, ‘‘রাতে বাড়িতে ছিলাম না। কিছু জানি না।’’ গ্রামের অধিকাংশ দোকানই ছিল বন্ধ। গ্রামের স্কুলেও ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল হাতেগোনা।
বীরভূমে ঘটনাক্রম
জানুয়ারি, ২০২১: খুন ভাদু শেখের দাদা বাবর শেখ।
সোমবার
• রাত সাড়ে ৮টা: রামপুরহাটের বগটুই মোড়ে বোমায় খুন ভাদু শেখ।
• রাত সাড়ে ৯টা: বগটুই গ্রামে বোমাবাজি, একাধিক বাড়িতে আগুন।
মঙ্গলবার
• ভোর ৩টে: রামপুরহাট মেডিক্যালে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় ভর্তি চার জন।
• ভোর সাড়ে ৩টে: বগটুই গ্রামে সোনা শেখের বাড়ি থেকে সাত জনের দেহ উদ্ধার।
• বেলা সাড়ে ১১টা: গ্রামে জেলা পুলিশ সুপার নগেন্দ্রনাথ ত্রিপাঠী।
• দুপুর ১টা: গ্রামে এল ভাদু শেখের মৃতদেহ।
• দুপুর ১টা ৩০: গ্রামে সিআইডির দল।
• দুপুর ২টো: গ্রামে এলেন এডিজি পশ্চিমাঞ্চল সঞ্জয় সিংহ।
• দুপুর ৩টে: ঘটনাস্থলে মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, রামপুরহাটের বিধায়ক আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল, লাভপুরের বিধায়ক অভিজিৎ সিংহ।
• সন্ধ্যা ৬টা: আতঙ্কে বগটুই গ্রাম ছাড়ল ভাদু শেখের পরিবার।
• সন্ধ্যা ৭টা: রামপুরহাট মেডিক্যালে আহতদের সঙ্গে দেখা করলেন জেলাশাসক বিধান রায়।
• রাত ৯টা: রামপুরহাট থানায় সিটের দল।
• রাত সাড়ে ৯টা: ৮টি দেহ নিয়ে যাওয়া হল গ্রামে।
এলাকার বাসিন্দারা পুরুষেরা সকলেই প্রায় গ্রামছাড়া। সারা রাত জেগে কাটিয়েছেন। সকাল হতেই গ্রাম ছাড়তে দেখা যাচ্ছিল একাধিক পরিবারকে। দিনভর দেখা যায়, প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও গবাদি পশু টোটোয় চাপিয়ে অনেক মহিলা কাঁদতে কাঁদতে গ্রাম ছাড়ছেন। আগুন ধরার ঘটনায় রাত থেকে মঙ্গলবার সন্ধে পর্যন্ত গ্রামে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সেই অন্ধকারের মধ্যেই গ্রাম ছাড়ছিলেন বাসিন্দারা। তেমনই এক মহিলা বললেন, ‘‘দাউদাউ করে জ্বলছে বাড়ি। কিছুক্ষণ পর পরই বোমার বিকট শব্দে বাড়ির দরজা জানালা কেঁপে উঠছিল। এক সময় মনে হচ্ছিল পুরো গ্রাম ধ্বংস হয়ে যাবে। কেউ প্রাণে বাঁচবে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy