ফাইল চিত্র।
‘‘বগটুই! সব সময় তটস্থ থাকতে হত, কখন ওখানে গাড়ি নিয়ে টহলে যেতে হয়!’’ হালকা চালে বলছিলেন এক সময় রামপুরহাট থানায় থাকা এক পুলিশ আধিকারিক। বস্তুত, রামপুরহাট শহর লাগোয়া এই গ্রাম যে অশান্তির জন্য পুলিশ-প্রশাসনের কাছে ‘সুপরিচিত’, সে কথা জানা যায় একটু খোঁজ নিলেই।
হালের রাজনীতিতে যে সব ক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গোলমালের অভিযোগ শোনা যায়, তেমন কিছুই কিন্তু নেই বগটুইয়ে। গ্রামে নেই কোনও পাথর বা কয়লা খাদান। নেই কোনও বালি খাদানও। জাতীয় সড়ক লাগোয়া আপাত সাধারণ এক জনবসতি। তবু এই গ্রামের কিছু বাসিন্দার নামে অভিযোগ জেলা পুলিশের খাতায় বারবার এসেছে। বাহুবলের সঙ্গে বার বার জড়িয়েছে বগটুইয়ের নাম। সেটা সাম্প্রতিক হত্যালীলার কয়েক বছর আগে থেকেই।
তৃণমূলের উপপ্রধান ভাদু শেখের খুন ও তার ‘বদলা’য় বগটুইয়ে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে খুনের আতঙ্কে এখনও বহু বাসিন্দা ঘরছাড়া। তবে অশান্তির জেরে এমন ঘরছাড়া হওয়ার ঘটনা নতুন নয় বগটুইয়ে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ২০১৬ সালে বগটুই গ্রামের পূর্বপাড়ায় ছাগলে ধানের বীজতলা খাওয়াকে কেন্দ্র করে বিবাদে বোমাবাজির ঘটনায় গ্রামের বেশ কিছু বাসিন্দা এখনও গ্রাম ছাড়া। তাঁদেরই এক জন, স্বামীহারা নিমরেজা বিবি। এখন তিনি থাকেন তারাপীঠের কাছে বুদিগ্রামে। পুরনো গ্রামের বাসিন্দাদের পুড়িয়ে মারার কথা জেনে ছুটে এসেছিলেন গ্রামে। তিনি অভিযোগ তুললেন সদ্য খুন হওয়া ভাদুর দিকেই। বললেন, ‘‘ছাগলে ধান খাওয়া নিয়ে ছেলের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। ভাদু শেখ ও তার লোকজনদের জন্যই মামলা হয়েছিল। তিন বছর জেল খেটেছে ছেলে। সঙ্গে জুড়ে দেয় মাদকের মামলাও। সেই থেকেই গ্রাম ছেড়েছি। ছেলেও বাইরে থাকে এখন। গ্রামের এতগুলো লোককে এ ভাবে মেরেছে শুনে গ্রামে এসেছিলাম।’’
অথচ ভাদুকেও এক সময় বগটুই ছাড়া হতে হয়েছিল। রাজ্যে ২০১১ সালে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার আগে বগটুই গ্রামে বাম-কংগ্রেসের দাপটই বেশি ছিল। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে গ্রামে তৃণমূল প্রভাব ফেলতে শুরু করে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভাদু শেখের স্ত্রী তৃণমূল প্রার্থী হন। কংগ্রেস প্রার্থীর কাছে তাঁর স্ত্রী ভোটে হারার পরে অত্যাচারের অভিযোগ তুলে ভাদু শেখ এবং তাঁর ভাই বাবর আলি পরিবার নিয়ে গ্রাম ছাড়েন। দু’বছর তাঁরা গ্রাম ছাড়া ছিলেন। এর পরে ২০১৬ সালে ছাগলে ধানের বীজতলা খাওয়া নিয়ে বোমাবাজির ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনার পরে ভাদুর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর লোকজন গ্রাম ছাড়লে সেই সুযোগ নিয়ে ভাদু ফের গ্রামে ফিরে আসেন।
স্থানীয় সূত্রে খবর, তখন থেকেই বগটুইয়ে ভাদুর ‘নিয়ন্ত্রণে’র শুরু। তখন থেকেই ভাদু রামপুরহাটের এক ‘প্রভাবশালী’ তৃণমূল নেতা এবং তৃণমূলের রামপুরহাট ১ ব্লকের সদ্য প্রাক্তন সভাপতি, সদ্য গ্রেফতার হওয়া আনারুল হোসেনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত হতে শুরু করেন। অভিযোগ, এক দিকে দলের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য, অন্য দিকে পুলিশের সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ দেখিয়ে এলাকায় ভাদু প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন। তখন ঘরছাড়া হওয়া গ্রামের অন্য পরিবারগুলির দাবি, তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও আবেদন পাঠিয়েও ঘরে ফিরতে পারেননি।
সেই সময়ই তৈরি হতে থাকে ভাদুর অনুগামী ‘বাহুবলী’দের দল। তৃণমূল কর্মীদের একাংশেরই অভিযোগ, ভাদু আনারুল-সহ একাধিক নেতাদের এই ‘চক্র’ এলাকায় রাজনৈতিক সমস্যা থেকে সামাজিক সমস্যা সব কিছুতেই প্রভাব খাটাত। রামপুরহাট শহরের রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই জানান, কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচন, স্কুল, সমবায় সমিতির নির্বাচনে এই সমস্ত বাহুবলীদের ‘ব্যবহার’ করা হত। বাসস্ট্যান্ড এলাকায় দখলদারি থেকে হাসপাতাল, নার্সিংহোমে চিকিৎসার গাফিলতিতে রোগী মৃত্যুতে ভাঙচুর— বাহুবল প্রদর্শনের এমন নানা ঘটনায় বগটুই গ্রামের ওই বাসিন্দাদের নাম জড়িয়ে পড়ত।
পরে রামপুরহাট থানা এলাকার পাথর শিল্প কিংবা বালি খাদানের তোলা আদায়ের ক্ষেত্রেও ওই বাহুবলীদের প্রভাব দেখা যেত বলে অভিযোগ উঠেছে। বছর খানেক আগে বাপি মণ্ডল নামে এক ব্যবসায়ীকে খুনের ঘটনায় বগটুই গ্রামের বাহুবলীদের নাম জড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি পুরসভা নির্বাচনে রামপুরহাট পুরসভা নির্বাচনে ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে একটি বুথে সিপিএম প্রার্থী এবং তাঁর স্ত্রী-পরিজনকের মারধর এবং ইভিএম ভাঙচুরের ঘটনায় সিপিএমের পক্ষ থেকেও ওই এই চক্রের লোকজনের নামে অভিযোগ দায়ের হয়।
তবে গ্রামে ভাদু-রাজের বিরোধী গোষ্ঠীও ছিল। ২০১৬-য় গ্রামে ফেরা থেকে ২০১৮ অবধি ভাদুর অন্যতম সঙ্গী ছিলেন ফটিক শেখ। পরে ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে ভাদুর সঙ্গে ফটিকের বিরোধ বাধে। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে ভাদু পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জয়ী হয়ে স্থানীয় বড়শাল গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান হন। ভাদু-রাজ আরও ডালপালা মেলে বগটুইয়ে। ফটিক তখন থেকেই ভাদুর বিরোধী বলে পরিচিত। ভাদু খুনের অভিযোগে নাম রয়েছে ফটিকের। বদলার আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছেন ফটিকের স্ত্রী মীনা বিবি।
রাজনৈতিক নেতা ও সেই সূত্রে পুলিশের সঙ্গে দহরম-মহরমের জেরেই ভাদুর অনুগামীরা এমন আগুন লাগাতে সাহস পেয়েছিল বলে অভিযোগ স্বজনহারাদের। সিবিআই যা তদন্ত করে দেখছে। কেমন ছিল সেই যোগাযোগ?
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy