ভাঁড়ারের দুরবস্থা নিয়ে রেল-কর্তৃপক্ষ বেজায় দুশ্চিন্তায়। কিন্তু পরিষেবার দুরবস্থা নিয়ে তাঁরা কতটা চিন্তিত? আদৌ চিন্তিত কি?
প্রশ্নটা শিয়ালদহ বিভাগের নিত্যযাত্রীদের। রোজকার ট্রেন-সফরে যাঁরা দুঃসহ যন্ত্রণা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রশ্ন তুলেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না তাঁরা। সংস্থার ভাঁড়ে মা ভবানী দশা ঘোচাতে রেল-কর্তৃপক্ষ যখন কর্মীদের পোশাকে পর্যন্ত বিজ্ঞাপন দেওয়ার কথা ভাবছেন, যাত্রীদের একাংশ সেখানে তাঁদের বিনা পয়সায় দিতে চাইছেন আয় বাড়ানোর সুলুক-সন্ধান।
বৈধ যাত্রীরা আসলে বাতলে দিতে চাইছেন এক ঢিলে পাখি মারা আর আম পেড়ে ফেলার কৌশল। বিনা পারিশ্রমিকে মুশকিল আসানের রাস্তা ধরিয়ে দিতে চাইলেও সেটা যাত্রীদের দিক থেকে একেবারে নিঃস্বার্থ অবদান, এমন অবশ্য নয়। তাঁদেরও সুবিধে হতে পারে কমবেশি।
কী সেই কৌশল?
যাত্রীদের বড় অংশের বক্তব্য, শিয়ালদহের বিভিন্ন শাখায় রোজ রোজ যে-অসংখ্য যাত্রী টিকিট না-কেটে ট্রেন সফর করেন, যথাযথ জরিমানা নিয়ে তাঁদের শায়েস্তা করলেই তো রেলের ভাঁড়ার উপচে পড়ার কথা। পাখি মারা মানে অবৈধ যাত্রীদের মোকাবিলা করে এ ভাবে রেলের ভাঁড়ার ভরে তোলার কথাই বলছেন বৈধ যাত্রীরা।
আর আম পাড়া হল টিকিট কেটে ট্রেনে ওঠা যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়া। স্বাচ্ছন্দ্য দিয়ে তাঁদের প্রসন্নতা আদায় করা। বিনা টিকিটের যাত্রীরা ধরপাকড় আর জরিমানার ভয়ে ট্রেন এড়িয়ে চললে বৈধ যাত্রীরা একটু স্বস্তিতে সফর করতে পারেন। আর ফাঁকির রাস্তা ছেড়ে বিনা টিকিটের যাত্রীরাও যদি টিকিট কাটতে শুরু করেন, তাতে রেলের বাড়তি লাভ। টাকাটা তাদের ভাঁড়ারেই উঠবে এবং সদিচ্ছা থাকলে রেল তাতে যাত্রী-স্বাচ্ছন্দ্যের বন্দোবস্তও করতে পারবে কিছুটা।
যাত্রী-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে রেলের যে ন্যূনতম নজরও নেই, শিয়ালদহের সব শাখায় দুঃসহ যন্ত্রণার নিত্যযাত্রাই তার প্রমাণ। আর বিনা টিকিটের যাত্রী ধরার কাজেও যে রেল-কর্তৃপক্ষের বিশেষ মন নেই, সেটা ধরিয়ে দিচ্ছে রেলেরই একটি সাম্প্রতিক বিজ্ঞপ্তি।
কী বলা হয়েছে ওই বিজ্ঞপ্তিতে?
রেলকর্তারা জানাচ্ছেন, ২৯ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত মাত্র সাত দিন পূর্ব রেল জোনে টিকিট পরীক্ষার বিশেষ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। তাতে বিনা টিকিটের যাত্রী ধরা পড়েছেন ৩৮ হাজার ৭৩২ জন। জরিমানা বাবদ ওই অবৈধ যাত্রীদের কাছ থেকে ৭৪ লক্ষ ৫২ হাজার ৬৫৫ টাকা আদায় হয়েছে।
অর্থাৎ ওই বিজ্ঞপ্তি থেকে এটা পরিষ্কার যে, রেল-কর্তৃপক্ষ এই জোনে লাগাতার টিকিট পরীক্ষার তাগিদ না-দেখানোয় বিপুল সংখ্যক যাত্রী বেমালুম বিনা টিকিটে চলাচল করছেন। তাতে কামরায় ভিড় উপচে পড়ছে। দমবন্ধ অবস্থায় সফর করতে বাধ্য হচ্ছেন টিকিট কাটা বৈধ যাত্রীরাও। সব ট্রেনে বাদুড়ঝোলা ভিড় নিত্য দৃশ্যমান। কিন্তু সেই ভিড়ের আর্থিক প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না রেলের ভাঁড়ারে। অথচ ভিড়ের চাপটা নিতে হচ্ছে বৈধ যাত্রিসাধারণকে।
কী রকম চাপ?
ইমন মিত্র নামে এক যাত্রীর অভিজ্ঞতা: বেলা ১০টায় শিয়ালদহমুখী লোকাল সোদপুরে ঢুকতেই ভিড় আছড়ে পড়ল কামরাগুলিতে। যত মানুষ ঝাঁপালেন, উঠতে পারলেন তার অর্ধেকেরও কম। ভিড় ঠেলে চেপেচুপে উঠতে গিয়ে কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে অনেকে পড়েও গেলেন প্ল্যাটফর্মে। ওই অবস্থাতেই ট্রেনটি ছেড়ে বেরিয়ে গেল। মেন লাইন থেকে ডানকুনি বা বনগাঁ থেকে ডায়মন্ড হারবার— সব শাখাতেই ছবিটা এক। কোনও মতে ঠেলেঠুলে ট্রেনের কামরায় সূচ্যগ্র মেদিনী দখল করার মরিয়া নিত্যসংগ্রাম।
একই অবস্থা শিয়ালদহ উত্তর-দক্ষিণ বা দমদম স্টেশন থেকে বিকেল-সন্ধ্যা-রাতের ফিরতি ট্রেনগুলিতেও। ভিড়ের চাপে যাত্রীদের শ্বাস বন্ধ হওয়ার অবস্থা। রেলকর্তাদের একাংশ কবুল করছেন, ভিড়ের চাপ মাথায় রেখে লোকাল ট্রেনগুলিকে অবিলম্বে ১২ কামরার করা দরকার। সময়মতো ট্রেন চালানো দরকার। আর দরকার পরিকাঠামোর উন্নয়ন।
কিন্তু শিয়ালদহে লোকাল ট্রেনের নিত্যযাত্রীদের কাছে রেলকর্তাদের এই সব মন্তব্য নিছকই কথার কথা। কারণ, বাস্তবে উন্নয়নের ছিটেফোঁটা দেখতে পাচ্ছেন না তাঁরা। সময়ে ট্রেনের দেখা তো মেলেই না। পর্যাপ্ত ট্রেন থাকলে এবং অবৈধ যাত্রী ধরে শায়েস্তা করতে পারলে বৈধ যাত্রীরা যেটুকু আরামে চলাচল করতে পারতেন, সেটাও স্বপ্নই থেকে গিয়েছে। যাত্রীদের অভিযোগ, লালু প্রসাদ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শেষমেশ সুরেশ প্রভু— কারও আমলেই এই ডিভিশনে লোকাল ট্রেনের নিত্যযন্ত্রণার কোনও উপশম হয়নি, হচ্ছে না।
১০ বছর ধরে লোকাল ট্রেনে ১২টি বগি দেওয়ার কথা চলছে। শিয়ালদহের দক্ষিণের একটি-দু’টি শাখায় সেই ব্যবস্থা চালুও হয়েছে। কিন্তু উত্তরে সেই কাজের অর্ধেকও শেষ হয়নি। প্ল্যাটফর্ম থেকে অবৈধ দখলদার তোলা না-গেলে কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। পরিকাঠামো পড়ে আছে আদ্যিকালে। নিত্যদিন ট্রেন লেট। বৃষ্টি হলেই সব সিগন্যাল অকেজো। রেলকর্তারা প্রায় রোজই বড় মুখ করে হরেক প্রকল্পের কথা ঘোষণা করছেন। কিন্তু শহরতলির নিত্যযাত্রীদের রোজনামচায় কোনও পরিবর্তনই আসছে না।
উল্টে শিয়ালদহ ডিভিশনের কর্তারা শনি-রবিবার অর্ধেকের বেশি ট্রেন বাতিল করে দিচ্ছেন। তাতে যাত্রীদের কষ্ট আরও বাড়ছে। যাত্রীদের বক্তব্য, শনি বা রবিবার এখন অনেক বেসরকারি অফিস খোলা থাকে। চাকরির বেশির ভাগ পরীক্ষাই থাকে ওই দু’টি ছুটির দিনে। ফলে নিত্যযাত্রী না-থাকলেও ট্রেনে ভিড় থাকছেই। যাত্রীদের তরফে বারবার আবেদন-নিবেদন করা সত্ত্বেও এই বিষয়ে কান দিতে চাইছেন না রেলকর্তারা। ফলে দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে যাত্রীদের।
রেলেরই হিসেব বলছে, গত চার-পাঁচ বছরে শিয়ালদহে লোকাল ট্রেনের যাত্রী বেড়েছে তিন গুণ। সংখ্যাটা এখন ১৭ লক্ষ। এর সঙ্গে রয়েছে কয়েক লক্ষ বিনা টিকিটের যাত্রী। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা প্রায় ২২ লক্ষ। বিনা টিকিটের যাত্রীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান হলে সংখ্যাটা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে জরিমানার টাকা ফেরাতে পারে ভাঁড়ারের স্বাস্থ্য। এবং সদিচ্ছা থাকলে সেই টাকায় যাত্রী-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থাও হতে পারে।
রেলকর্তারা শুনছেন কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy