গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
লোকসভা ভোটের ফল ঘোষণার পরের দেড় মাসে বাংলার উত্তর থেকে দক্ষিণে পর পর কিছু ঘটনা বিড়ম্বনায় ফেলেছিল শাসক তৃণমূলকে। কিন্তু তাতে তারা ‘উদ্বিগ্ন’ ছিল না। কারণ, ওই ঘটনাগুলির কোনওটি নিয়েই বিরোধী দলগুলি সে ভাবে আন্দোলন তৈরি করতে পারেনি। সবটাই ছিল সংবাদমাধ্যম বা সমাজমাধ্যমে।
আরজি কর-কাণ্ডের পর যখন নাগরিক ক্ষোভ বেরিয়ে আসছে অনর্গল, তখন কি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি সেই স্রোতে ভেসে থেকেই ‘প্রাসঙ্গিক’ হতে চাইছে?
প্রকাশ্যে সে কথা অনেক বিরোধী নেতাই স্বীকার করছেন না। বরং বিভিন্ন ভাবে তাঁদের দলীয় যুক্তি দিচ্ছেন। কিন্তু একান্ত আলোচনায় তাঁদের দলেরই অনেক নেতার মেনে নিতে আপত্তি নেই যে, যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে নাগরিক আন্দোলনের স্রোতে ভেসে থাকা ছাড়া অন্য উপায় আপাতত নেই। ফলে কোনও দল চাইছে কৌশলে নাগরিক আন্দোলনে মিশে গিয়ে ভেসে থাকতে। কোনও দল আবার ধীরে ধীরে নাগরিক আন্দোলনে নিয়ন্ত্রণ তৈরি করতে চাইছে। আবার সমান্তরাল ভাবে নাগরিক সমাজের মধ্য থেকেও স্বর উঠছে ‘দলহীন’ আন্দোলনের। যে আন্দোলনে মিশে যাচ্ছে হাথরাস থেকে কামদুনি, উন্নাও থেকে আরজি কর। উঠছে বাম জমানার কথাও। অর্থাৎ বুঝিয়ে দেওয়া যে, কেউ ‘ধোয়া তুলসীপাতা’ নয়।
লোকসভা ভোটে বিপুল সাফল্য পেয়েছিল তৃণমূল। ভোটের ফল ঘোষণার এক মাসের মধ্যেই পর পর বেশ কিছু ঘটনা শাসকদলের বিড়ম্বনা বাড়িয়েছিল। উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ায় ‘জেসিবি’ নামক স্থানীয় বাহুবলী যে ভাবে রাস্তায় ফেলে এক মহিলাকে পিটিয়েছিলেন, তার ভিডিয়ো দেখে শিউরে উঠেছিলেন প্রায় সকলেই। সেই প্রেক্ষিতেই প্রকাশ্যে এসেছিল স্থানীয় স্তরে জেসিবির তৃণমূল-ঘনিষ্ঠতার পরিচয়। তার পরেই প্রকাশ্যে আসে আড়িয়াদহের জয়ন্ত সিংহ ওরফে ‘জায়ান্ট’ সিংহের দাদাগিরির একের পর এক ঘটনা। তার বাহিনীর তাণ্ডব। সেই জয়ন্তেরও শাসক-ঘনিষ্ঠতার অকাট্য সব প্রমাণ প্রকাশ্যে আসে। তা ছাড়া হকার উচ্ছেদ নিয়ে রাজ্য সরকারের ঘোষণা, বিক্ষোভের মুখে পিছিয়ে আসা, জায়গায় জায়গায় ‘চোর’ সন্দেহে গণপিটুনি এবং মৃত্যু-সহ নানা ঘটনায় তৃণমূল যে দফায় দফায় চাপে পড়ছিল, তা শাসকদলের নেতারাও ঘনিষ্ঠমহলে গোপন করতেন না।
কিন্তু আরজি কর-কাণ্ড ‘ভিন্ন প্রেক্ষাপট’ তৈরি করে দিয়েছে বাংলায়। বিরোধী দলগুলি চাইছে গণক্ষোভের ‘রাজনীতিকরণ’ ঘটিয়ে সরাসরি তৃণমূল বিরোধিতার আঙ্গিকে বিষয়টিকে নিয়ে যেতে। কিন্তু তা করতে গিয়ে কসরত করতে হচ্ছে প্রায় সব দলকেই। শুরু করেও অনেক সময়ে তা ধরে রাখতে পারছে না কেউ কেউ। যেমন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী প্রথমে জাতীয় পতাকা হাতে নবান্ন অভিযানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার পর হঠাৎ তৈরি ‘ছাত্র সমাজ’-এর নামে সেই অভিযানে তুমুল অশান্তি, রক্তপাত দেখেছে রাজ্য। সেই অরাজনৈতিক মোড়ক খুলে পরদিন বিজেপি বাংলা বন্ধের ডাক দিয়েছিল। যা সফল হয়নি। সিপিএমের ছাত্র-যুবরাও পতাকা নিয়ে আন্দোলন করছেন। কিন্তু পাশাপাশিই তাঁরা ‘পতাকাহীন’ হয়ে মিশে যাচ্ছেন নাগরিক আন্দোলনে।
রাজনৈতিক দলগুলি কি নাগরিক আন্দোলনের স্রোতে ভেসেই ‘প্রাসঙ্গিক’ থাকতে চাইছে? রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির মুখপাত্র রাজর্ষি লাহিড়ীর বক্তব্য, ‘‘আমরা অপ্রাসঙ্গিক কবে হলাম, যে প্রাসঙ্গিক হতে হবে? ৯ অগস্ট আরজি করের সামনে যদি অগ্নিমিত্রা পাল, সজল ঘোষেরা না যেতেন, তা হলে কি এই নাগরিক আন্দোলন শুরু হত? মানুষ কি জানতে পারত?’’ সমাজমাধ্যমে প্রায় একই আখ্যান তৈরি করতে চাইছে সিপিএম। তাদের বক্তব্য, যুবনেত্রী মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ৯ অগস্ট রাতে যদি নির্যাতিতার দেহ নিয়ে প্রস্থানোদ্যত শববাহী গাড়ি না রোখা হত, তা হলে লোকে জানতেই পারতেন না আরজি করে কী ঘটে গিয়েছে। সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘নাগরিক আন্দোলনে স্রোতে ভেসে প্রাসঙ্গিক থাকার কোনও অভিপ্রায় আমাদের নেই। নাগরিক হিসাবেই আমরা নাগরিক আন্দোলনে থাকছি। আবার পৃথক ভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচিও করছি। এর মধ্যে কোনও সংঘাত নেই।’’ কংগ্রেস নেতা সৌম্য আইচ রায়ের অবশ্য উপলব্ধি, ‘‘২০০৭ সাল থেকে বামেদের বিরুদ্ধে একের পর এক ঘটনায় এ ভাবেই নাগরিক আন্দোলন হয়েছিল। যা প্রভাব ফেলেছিল রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও। এখন মানুষের যে মনোভাব দেখা যাচ্ছে, তাতে সব বিরোধী দলগুলিকেই কমবেশি সেই আন্দোলনে থাকতে হচ্ছে এবং হবে।’’
শাসক তৃণমূল অবশ্য এখনও মনে করছে না, এই ক্ষোভ ভোটের বাক্সে প্রতিফলিত হবে। তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘বিষয়ভিত্তিক আন্দোলন এবং সার্বিক ভাবে রাজনীতিকে প্রভাবিত করা— দুটো এক জিনিস নয়। আরজি করের জঘন্য ঘটনার প্রতিবাদে মানুষ ক্ষোভ জানাচ্ছেন। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁরা সবাই ভোটে তৃণমূলকে গিয়ে হারিয়ে দেবেন, তেমন নয়। বিরোধীরা রাজনৈতিক স্বার্থে জনতার ক্ষোভকে ব্যবহার করতে চাইছে। কিন্তু জনতাই তা প্রত্যাখ্যান করছে। আরজি করের সঙ্গেই দেশের আরও নানা প্রান্তে ঘটা নারী নির্যাতন নিয়ে প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে।’’
‘মেয়েদের রাত দখল’ আন্দোলনে সারা বাংলায় জনস্রোত দেখা গিয়েছিল। সেই আন্দোলনের অন্যতম আহ্বায়ক রিমঝিম সিংহ রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকাকে কী ভাবে দেখছেন? তাঁর কথায়, ‘‘আরজি কর-কাণ্ড বারুদের স্তূপের মধ্যে একটা ফুলকি জ্বেলে দিয়েছে। তার ফলেই ক্ষোভের আগুন এই ভাবে দাউদাউ করে জ্বলছে। রাজনৈতিক দলগুলি এখানে সে ভাবে পরিসর খুঁজে পাচ্ছে না। তার কারণ, মানুষ সংশ্লিষ্ট দলগুলির উদ্দেশেও প্রশ্ন তুলছে।’’ তবে রিমঝিম স্পষ্ট বলেছেন, বিভিন্ন দুর্নীতি এবং নারী নির্যাতনের ঘটনায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ছিলই। সেটা এই ঘটনার পরে বিস্ফারিত হয়েছে।
অনেকের মতে, নাগরিক আন্দোলনকে ‘দলীয়’ ভাবে কব্জা করার চেষ্টা যুগে যুগে হয়ে এসেছে। কখনও তা স্বাভাবিক নিয়মেও হয়ে গিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ২০০৭ থেকে বামেদের বিরুদ্ধে যে নাগরিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার সুফল পেয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু এখন কী হবে? নাগরিক আন্দোলনের অনেক সংগঠকই এখনকার পরিস্থিতিতে তেমন কোনও সম্ভাবনা দেখছেন না। তবে তাঁরা মানছেন যে, ‘রং’ লাগানোর চেষ্টা হচ্ছে। যেমন রবিবার দুপুরে কলকাতায় যে নাগরিক মিছিল হতে চলেছে, তার পোস্টারে লেখা হয়েছে, ‘এই মিছিলের রং সাদা-কালো, বিচারের রঙের মিছিল।’
আন্দোলনকে রাঙিয়ে দিতে মরিয়া রাজনৈতিক দলগুলি। নাগরিকদের তাগিদ সাদা-কালো রাখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy