Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

স্বাস্থ্যকেন্দ্রই সার, নেই পরিষেবা

স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বেড, এক্সরে মেশিন, অ্যামবুল্যান্স, প্রয়োজনীয় ওষুধ- সব হাজির। দেখা মেলে ডাক্তারবাবুও। নেই শুধু পরিষেবা! নেই মানে? অধিকাংশ সময় ডাক্তারদের দেখা পাওয়া যায় না। এক্সরে মেশিনে নিয়মিত ছবি তোলা হয় না। রোগী গেলে সঙ্গে সঙ্গে বলা হয় ‘রেফার টু সিউড়ি’। চলে না অ্যামবুল্যান্স। মহম্মদবাজারের ব্লক প্রাইমারি হেলথ সেন্টারের স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে অভিযোগ এমনই।

পরিষেবার এমনই হাল যে, শয্যা রয়েছে। রোগি নেই। —নিজস্ব চিত্র

পরিষেবার এমনই হাল যে, শয্যা রয়েছে। রোগি নেই। —নিজস্ব চিত্র

ভাস্করজ্যোতি মজুমদার
শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:১৮
Share: Save:

স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বেড, এক্সরে মেশিন, অ্যামবুল্যান্স, প্রয়োজনীয় ওষুধ- সব হাজির। দেখা মেলে ডাক্তারবাবুও। নেই শুধু পরিষেবা!

নেই মানে? অধিকাংশ সময় ডাক্তারদের দেখা পাওয়া যায় না। এক্সরে মেশিনে নিয়মিত ছবি তোলা হয় না। রোগী গেলে সঙ্গে সঙ্গে বলা হয় ‘রেফার টু সিউড়ি’। চলে না অ্যামবুল্যান্স। মহম্মদবাজারের ব্লক প্রাইমারি হেলথ সেন্টারের স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে অভিযোগ এমনই।

এলাকার শিল্প-ইতিহাস বহু প্রাচীন। কিন্তু এলাকায় উন্নয়নের সম্ভবনা থাকায় বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে এখানে প্যাটেলনগর ‘টাউনশিপ’ গড়ে ওঠে। কিন্তু আজও জেলার পিছিয়ে পড়া ব্লক গুলির অন্যতম মহম্মদবাজার ব্লক। রাস্তাঘাট বা যোগাযোগের সুযোগ সুবিধার কারণে মহম্মদবাজারেও জনসংখ্য বেড়ে চলেছে। কিন্তু স্বাস্থ্য পরিষেবা এখনও বেহাল।

বিধান রায়ের স্বপ্নের প্যাটেলনগর হওয়ার আগে পর্যন্ত মহম্মদবাজারে সরকারি কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছিল না। বর্তমান স্বাস্থ্যকেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, প্যাটেলনগরের ৯ একর জায়গা নিয়ে ১৯৬১-৬২ সালে মহম্মদবাজার ব্লক প্রাইমারি হেলথ সেন্টার গড়ে ওঠে। এলাকার লোকজন আনন্দে মেতে ওঠেন। বাসিন্দাদের মনে স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার স্বপ্ন জাগে। আমজনতার প্রশ্ন, স্বাস্থ্য পরিষেবার সেই স্বপ্ন কি আজও বাস্তবায়িত হয়েছে?

বাসিন্দাদের দাবি, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বাইরেটা বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। দেখলে মনে হবে কোনও প্রাইভেট হাসপাতাল। কিন্তু ভিতরটা একেবারেই অন্যরকম। ডাক্তারবাবুরা আছেন, কিন্তু অধিকাংশ সময় তাঁদের দেখা পাওয়া যায় না। কেউ কেউ সপ্তাহে দু-তিনদিন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে থাকেন। অনেক সময় সামান্য জ্বর-জ্বালা হলেও সিউড়ি রেফার করে দেন কর্তব্যরত চিকিৎসকরা। আর তার চেয়ে বড় কিছু হলে তো কথাই নেই। এলাকার পাতামুনি বাসকী, মেনকা সোরেন, সুমিতা বাসকীরা বলছেন, “অন্তর্বিভাগের ভিতরে গেলেই দেখবেন, অধিকাংশ সময় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বেড ফাঁকা। কোনও রোগী নাই। যদি সত্যি করে ভাল চিকিৎসা বা পরিষেবা মিলত, তাহলে আর যাই হোক হাসপাতালের বেড এভাবে খালি থাকত না।”

মহম্মদবাজারের পাথর ও খড়িমাটি শিল্পাঞ্চল-সহ এলাকার লোকজনের একমাত্র ভরসা এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি। পাথরের ডাস্ট, খড়িমাটি ও রাস্তার ধুলোর কারণে এলাকার বহু মানুষের মধ্যেই যক্ষা রোগের জীবানু পাওয়া গিয়েছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এক্সরে মেশিন আছে। এলাকার মানুষের দাবি, সপ্তাহে এক বা দু’দিনের বেশি এক্সরে পরিষেবা পাওয়া যায় না। আর এক্সরে করাতে গেলে এমন ‘মেজাজ’ দেখান, যে দয়া করে এক্সরে করে দিচ্ছেন।

প্রদীপ মিত্র, শ্যামল দাস, রুকমনি বিবি, আবদুল সামাদরা বলেন, “প্রাথমিক চক্ষু পরীক্ষার যন্ত্রপাতি থাকলেও চক্ষু পরীক্ষাও হয় না। তবে সঙ্গে নেতা বা দাদা দিদি কেউ থাকলে বা তাঁদের কারও চিঠি থাকলেও কিছুটা কাজ হয়।” পাঁচামি পাথর খাদান এলাকার রোগী বা তাঁদের পরিবারের লোকজনের মতোই অভিযোগ করেন, মহম্মদবাজারের প্রাক্তন ব্লক সভাপতি জীতেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য(বর্তমানে বিজেপি নেতা) ও মহম্মদবাজারের সিপিএমের জোনাল কমিটির সদস্য শ্রীজিৎ মুখোপাধ্যায়র। তাঁদের দাবি, “আগে এমনটা ছিল না। বহিঃবিভাগ ও অর্ন্তবিভাগে প্রচুর রোগী হত। অ্যামবুল্যান্স চলত। তবে এক্সরে হওয়া না হওয়া নিয়ে তখনও সমস্যা ছিল।”

অন্যদিকে তৃণমূলের মহম্মদবাজার ব্লকের কার্যকরী সভাপতি তাপস সিংহের দাবি, “বাম আমলে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র এতই নোংরা ছিল যে, নাকে রুমাল না দিয়ে ভিতরে ঢোকা যেত না। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জল পরিষেবার হালও খুব খারাপ ছিল। ঠিকমত ওষুধ মিলত না। কার্যত সাধারণ মানুষ চিকিৎসা পেতেন না। তবে আরও ভাল পরিষেবার জন্য যা করার তাই করা হবে।”

৩০ শয্যার ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পা রাখলেই অভিযোগগুলির সত্যতার প্রমাণ মিলবে। সত্যিই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বাইরেটা বেশ চকচকে। মহিলা অন্তর্বিভাগে কোনও রোগী নাই। পুরুষ বিভাগে একজন বয়স্কা রোগিণী আছেন। কর্তব্যরত নার্স বলেন, “কোনও রোগী না থাকায় ওই মহিলাকে এদিকে রাখা হয়েছে। অত্যাধুনিক এসএনএসইউ-এর বেড দুটিতেও কেউ নেই।”

যে মহিলা ভর্তি আছেন, তাঁর মেয়ে চিন্তা বাগদি বলেন, “মায়ের শরীর খারাপ হচ্ছিল। তাই গত রাতে এখানে ভর্তি করেছি। এখন সুস্থ আছে। আজ কালেই নিয়ে চলে যাব।” হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ভাদু বাগদি বলেন, “আমি ও মেনকা দাস দীর্ঘ দিন থেকে এই হাসপাতালে দায়মার কাজ করি। আমাদেরকে মাত্র ৫৫০টাকা বেতন দেয়।” কর্মীদের একাংশের অভিযোগ, টিনের ছাউনি দেওয়া অন্তর্বিভাগে শীত ও গরমের সময় কাজ করতে ভীষণ অসুবিধে হয়। গরমে পাখা গুলোও ঠিক মতো চলে না।

বিএমওএইচ জহিরুল আলমের দাবি, “আগের মতো রোগী হয় না এই অভিযোগ ঠিক না। বরঞ্চ আগের চেয়ে রোগী বেশী হয়। রেজিস্টারই তার প্রমাণ। এক্সরে মেশিন, টেকনেশিয়ান সবই ছিল। তবে এক্সরে হত না। গত ৮-৯ মাস হল এক্সরে পরিষেবা চালু করা গেছে। এখন সপ্তাহে দু’দিন এক্সরে করা হয়। টেকনিসিয়ানকে বলেছি নিয়ম মতো ছ’দিনই এক্সরে করতে হবে। আর অ্যামবুল্যান্স খারাপ থাকায় তা চালানো সম্ভব হয় না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।”

কিন্তু সিউড়ি রেফার কেন?

স্বাস্থ্যকর্তার উত্তর, “চিকিৎসার প্রয়োজনেই সিউড়ি পাঠাতে হয়। প্রয়োজনে বর্ধমান কলকাতাও পাঠাতে হয়। কারণ আমাদের এখানে কোনও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নাই।”

কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর বীরভূম’। ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, বীরভূম বিভাগ, জেলা দফতর আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE