Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
ইন্দিরা আবাস যোজনার কাজ ঢিমেতালে

বাড়ি হয়নি বাঁকুড়ার ২০ ব্লকেই

মাটির দেওয়ালের উপরে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা চালের ছাউনির নীচে বসবাসকারী পরিবার নেহাত কম নয় বাঁকুড়া জেলায়। ফি বছর বর্ষায় বা ঝড়ের দাপটে এই সব ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়াল চাপা পড়ে মৃত্যুর ঘটনাও কম ঘটে না। অথচ দারিদ্রসীমার নীচে (বিপিএল) বসবাসকারী পরিবারগুলির পাকা বাড়ি বানানোর কেন্দ্রীয় প্রকল্প ‘ইন্দিরা আবাস যোজনা’ মুখ থুবড়ে পড়েছে জঙ্গলমহলের এই জেলায়!

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৫ ০১:৩৪
Share: Save:

মাটির দেওয়ালের উপরে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা চালের ছাউনির নীচে বসবাসকারী পরিবার নেহাত কম নয় বাঁকুড়া জেলায়। ফি বছর বর্ষায় বা ঝড়ের দাপটে এই সব ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়াল চাপা পড়ে মৃত্যুর ঘটনাও কম ঘটে না। অথচ দারিদ্রসীমার নীচে (বিপিএল) বসবাসকারী পরিবারগুলির পাকা বাড়ি বানানোর কেন্দ্রীয় প্রকল্প ‘ইন্দিরা আবাস যোজনা’ মুখ থুবড়ে পড়েছে জঙ্গলমহলের এই জেলায়!

প্রশাসনিক রিপোর্ট অনুযায়ী, চলতি অর্থবর্ষে এই প্রকল্পে জেলার ২২টি ব্লকের মধ্যে ২০টি ব্লকই কাগজে কলমে একটি বাড়িও তৈরি করতে পারেনি। অথচ বাড়ি বানানোর লক্ষ্যমাত্রা নেহাত কম ছিল না জেলা জুড়ে। অর্থবর্ষ শেষ হতে বাকি আর ক’টি দিন। “এই পরিস্থিতিতে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছতে গেলে আলাদিনের জিনকে দরকার!”আড়ালে মানছেন জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্তা।

প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, বাঁকুড়া ১ ও গঙ্গাজলঘাটি ব্লক ছাড়া কাগজে কলমে আর কোনও ব্লকেই ইন্দিরা আবাস যোজনায় একটিও বাড়ি বানানো যায়নি। এই প্রকল্পে বাড়ি বানানোর ক্ষেত্রে বাঁকুড়া ১ ব্লকের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৩৮টি এবং গঙ্গাজলঘাটির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৩০টি। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাঁকুড়া ১ ব্লকে ১৭৮টি এবং গঙ্গাজলঘাটিতে মাত্র ২৫টি বাড়ি তৈরি হয়েছে। প্রশাসনিক রিপোর্ট বলছে, বাকি ব্লকগুলিতে একটিও বাড়ি তৈরি হয়নি। এই ব্লকগুলির মধ্যে জেলার জঙ্গলমহলের চারটি সারেঙ্গা, সিমলাপাল, রাইপুর ও রানিবাঁধ ব্লকও রয়েছে। বহু ক্ষেত্রেই বাড়ি অর্ধেক তৈরি হয়ে পড়ে আছে। সচেতনতা বা প্রচারের অভাবে উপভোক্তারাও সে কথা স্থানীয় পঞ্চায়েতে জানাচ্ছেন না। উল্লেখ্য, সিমেন্টের দেওয়ালের উপরে টিন বা অ্যাসবেস্টেসের ছাউনির বাড়ি বানানোর জন্য ইন্দিরা আবাস যোজনায় ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। কেবলমাত্র বিপিএল পরিবারই এই প্রকল্পের সুবিধা পেতে পারে। প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েত বিপিএল তালিকা অনুসারে গ্রাহকদের নামের তালিকা বানিয়ে পঞ্চায়েত সমিতিতে এই প্রকল্পের জন্য আবেদন করে। পঞ্চায়েত সমিতি জেলা পরিষদের কাছে সেই তালিকা পাঠিয়ে দেয়। জেলা পরিষদ বাড়ি বানানোর কোটা নির্দিষ্ট করে টাকা দেয়। পুরো টাকা তিনটি দফায় দেওয়া হয়।

প্রশাসন সূত্রের খবর, প্রথম ধাপে প্রায় ১৮ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এই টাকায় গ্রাহককে বাড়ি তৈরির জন্য ভিত কাটতে হয়। সেই কাজ শেষ হলে পঞ্চায়েত নির্মীয়মাণ বাড়িটির ছবি তুলে দ্বিতীয় দফার টাকা চায়। দ্বিতীয় দফায় প্রায় ৪৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। সেই টাকায় বাড়ির গঠনের কাজ শেষ হলে একই ভাবে ছবি সহ প্রমান দেখিয়ে তৃতীয় দফায় প্রকল্পের অবশিষ্ট টাকা চাওয়া হয়। এই প্রকল্পে টাকা সরাসরি গ্রাহকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দিয়ে দেওয়া হয়। বাড়ি বানানোর দায়িত্বও পুরোপুরি গ্রাহকের।

তা হলে কোথায় আটকে যাচ্ছে এই প্রকল্পের গতি?

জেলা প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, “বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হচ্ছে। কিন্তু, তা শেষ হচ্ছে না। তৃতীয় দফার টাকা যতক্ষণ না গ্রাহককে দেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ অবধি বাড়ি তৈরি হয়েছে বলে কাগজে কলমে ধরা যায় না।” তাঁর যুক্তি, বাড়ি তৈরি শুরু হয়ে যাওয়ার পরে মাঝপথেই সেই কাজ থমকে গিয়ে খেই হারিয়ে যাচ্ছে। জেলার এক বিডিও বলছেন, “অন্য কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলিতে টেন্ডার করে গ্রাহকদের বাড়ি বানিয়ে দেয় জেলা বা ব্লক প্রশাসন। ইন্দিরা আবাসের ক্ষেত্রে পুরো কাজটাই করতে হয় গ্রাহকদের। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, বাড়ি বানানোর টাকা গ্রাহকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢোকার পরে গ্রাহক সেই টাকায় বাড়ি না বানিয়ে অন্য খাতে খরচ করে ফেলেছেন।” ছাতনা ব্লকের শালডিহা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান টেলু কর আবার দাবি করছেন, “বাড়ি বানানো হচ্ছে না, এ কথা ভুল। ইন্দিরা আবাস যোজনায় চলতি অর্থবর্ষে ৮০টি ও গত অর্থবর্ষে ৫৪টি বাড়ি বানানোর কাজ শুরু হয়েছে আমাদের পঞ্চায়েতে। বেশির ভাগ গ্রাহকই দ্বিতীয় দফার কাজ শেষ করে ফেলেছেন। কিন্তু গ্রাহকেরা শেষ দফার টাকার জন্য গ্রাম পঞ্চায়েতের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না।”

ঘটনা হল, দ্বিতীয় দফার টাকা পেয়ে সেই পর্বের কাজ শেষের পরে যে তৃতীয় বা শেষ দফার টাকার জন্য পঞ্চায়েতে আবেদন করতে হয়, সেই নিয়ম জানেন না অনেক গ্রাহকই! এর পিছনে রয়েছে স্থানীয় স্তরে প্রচারের অভাব। শালডিহা পঞ্চায়েতেরই ছাতাপাথর এলাকার বাসিন্দা পদ্মা রায় যেন এই প্রকল্পে বাড়ি বানানোর জন্য দ্বিতীয় দফার টাকা পেয়েছেন। ওই দফার কাজও সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। অথচ কেন তিনি তৃতীয় দফার টাকার জন্য আবেদন করেননি, জানতে চাওয়া হলে পদ্মাদেবীর স্বামী শান্তি রায় বলেন, “আবেদন করার নিয়ম আছে বলেই জানতাম না। বাড়ির দেওয়ালে পলেস্তরা করার কাজ এখনও বাকি। আরও কিছু টাকা পেলে ভাল হয়।” একই জবাব দিয়েছেন দ্বিতীয় দফার টাকা পাওয়ার পরে বাড়ির কাজ বন্ধ রাখা এই অঞ্চলেরই আর এক গ্রাহক আঙুরবালা রায়। তাঁর কথায়, “টাকার জন্য কখন আবেদন করতে হবে, কী ভাবে করতে হবে, কিছুই তো জানি না।”

ওন্দা ব্লক অফিস সূত্রের খবর, মোট ১২৮৬টি বাড়ি বানাবার কাজ শুরু হয়েছে এই ব্লকে। যার মধ্যে ৩৯৬টি বাড়ি দ্বিতীয় দফার টাকা পেয়েছে। কাজের গতি এত শ্লথ কেন জানতে চাওয়া হলে ওন্দার বিডিও শুভঙ্কর ভট্টাচার্যও বলেন, “অনেক গ্রাহকই কাজ শেষ হলে পঞ্চায়েতে গিয়ে শেষ পর্যায়ের কাজের জন্য টাকার আবেদন করছেন না। তাই জেলাশাসকের নির্দেশ মতো আমরা আর গ্রাহকের আবেদনের জন্য অপেক্ষা করছি না। ব্লক থেকে প্রতিটি অঞ্চলে প্রতিনিধিদল গিয়ে বাড়ি তৈরির কাজ কতটা হল, তা খতিয়ে দেখে পরবর্তী দফার টাকার জন্য আবেদন করার কাজ শুরু করেছে। এতে কাজের গতি বেড়েছে।” যদিও ঘটনা হচ্ছে, এ কাজ যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। ব্লক প্রশাসনের এত লোকবলও নেই। তাই আসল সমস্যা মিটছে না।

ফলে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (অর্থবর্ষ শেষ হওয়ার আগে) জেলা প্রশাসন লক্ষ্যমাত্রার কতটা কাছে আসতে পারবে, তার সদুত্তর মিলছে না। বাড়ি তৈরিরর এই কেন্দ্রীয় প্রকল্পটির বর্তমান অবস্থার জন্য পরিকল্পনার অভাবকেই দায়ী করেছেন বাঁকুড়া জেলা পরিষদের বিরোধী দলনেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “পরিকল্পনা করে এগোলে কাজের গতি বাড়ে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই জিনিসটারই অভাব দেখতে পাচ্ছি। যার ফলে শুধু ইন্দিরা আবাসই নয়, আরও নানা প্রকল্পের গতি কমছে।” অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও রাজস্ব) পার্থ ঘোষ বলেন, “প্রকল্পের গতি একেবারেই থমকে গিয়েছে, তা বলা ঠিক হবে না। কাজ হচ্ছে। তবে, কাজের গতি বাড়াতে আমরা বেশ কিছু নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

অন্য বিষয়গুলি:

indira awas yojana bankura rajdeep bandyopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE