অনুব্রত-বিরোধী ‘হাওয়া’য় নিজের গড়েই কাবু তৃণমূল।
জেলার দু’টি লোকসভা আসনই তারা নিজেদের পকেটে পুরেছে। কিন্তু সেই একই ফলের হিসেব আবার বলছে, শাসক দল হারিয়েছেও অনেক কিছু। এক দিকে, পঞ্চায়েত ভোটের পর থেকেই সংবাদের শিরোনামে থাকা কসবা পঞ্চায়েতে তৃণমূল হারের মুখ দেখেছে। অন্য দিকে, হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বে দীর্ণ খয়রাশোল ব্লকের চারটি পঞ্চায়েতও। রাজনীতির কারবারিদের বিশ্লেষণ, দু’টি ক্ষেত্রেই দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বিরোধী গোষ্ঠীর প্রবল অসন্তোষ সুবিধা করে দিয়েছে বিরোধীদেরই। কোথাও অভূতপূর্ব ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে বিজেপি, কোথাওবা এগিয়ে গিয়েছে সিপিএম। বীরভূমে এই বিশেষ ‘ফল’ই চোনা ফেলেছে তৃণমূলের বিপুল জয়ে।
লোকসভা ভোটের প্রচারে কসবা পঞ্চায়েত এলাকায় বারবার পথসভা, জনসভা, মিছিল করেছে শাসক দল। একাধিক বার ঘুরে গিয়েছেন প্রার্থী থেকে তৃণমূলের জেলা নেতৃত্ব। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। লোকসভা ভোটের ফলের হিসেবে দলেরই ‘বিক্ষুব্ধ’দের হাতে থাকা কসবা পঞ্চায়েতে সিপিএমের থেকে পিছিয়ে রয়েছেন অনুব্রত। জানা গিয়েছে, বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের বিজয়ী তৃণমূল প্রার্থী অনুপম হাজরার থেকে ওই পঞ্চায়েতে ২,৬৩৫টি ভোট বেশি পেয়েছেন সিপিএম প্রার্থী রামচন্দ্র ডোম। পঞ্চায়েতের ১৫টির মধ্যে ১৪টি গ্রাম সংসদেই পিছিয়ে তৃণমূল। ফলে হিসেব বলছে এই মুহূর্তে ওই পঞ্চায়েতের মোট ১২টির মধ্যে ১১টি আসনেই এগিয়ে সিপিএম। শাসক দল কেবল মাত্র ২৩টি ভোটে এগিয়ে রয়েছে কন্দর্পপুরে। তৃণমূল পিছিয়ে সাগরবাবুর বাড়ি বাঁধ নবগ্রামেও। শুধু তা-ই নয়, সাগর ঘোষ খুনে অন্যতম অভিযুক্ত সাত্তোর অঞ্চলের সম্পাদক তথা পঞ্চায়েতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা শেখ মুস্তফা নিজের গ্রামেই প্রায় ৩০০ ভোটে সিপিএমের থেকে পিছিয়ে পড়েছেন।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে কসবা পঞ্চায়েত নির্দল তথা বিক্ষুব্ধ তৃণমূলদের দখলে এসেছিল। প্রধান হন শঙ্করী দাস। উপপ্রধান হন তৃণমূলের প্রতীকে জেতা আর এক ‘বিক্ষুব্ধ’ পার্বতী বাগদী। দলের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া এই ‘বিক্ষোভে’র জেরেই ওই পঞ্চায়েতে তৃণমূলের খারাপ ফল হয়েছে বলে রাজনীতির কারবারিদের মত। স্বাভাবিক ভাবেই ভোটের এই পরিসংখ্যান দেখে অনুব্রত-বিরোধীরা এখন থেকেই বলতে শুরু করেছেন, এই ফলে জেলা সভাপতিরই নৈতিক পরাজয় হয়েছে।
একই হাল হয়েছে খয়রাশোলেও। জেলার দুই দাপুটে নেতা নিহত অশোক ঘোষ এবং তাঁরই খুনে অভিযুক্ত অশোক মুখোপাধ্যয় গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব বহু চর্চিত। তার মধ্যে অভিযুক্ত নেতা অনুব্রত অনুগামী বলেই পরিচিত। এখানেও প্রবল অনুব্রত-বিরোধী হাওয়ার ফাঁক থেকে লাভের মুখ দেখেছে বিজেপি। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে খয়রাশোল ব্লকের ১১১টি পঞ্চায়েত আসনের মধ্যে ৮৬টি আসন জিতে দশটি পঞ্চায়েতের মধ্যে ৯টিরই ক্ষমতা দখল করেছিল তৃণমূল। ১৮টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিল সিপিএম। বিজেপি পেয়েছিল মাত্র একটি আসন। কিন্তু গেল লোকসভা ভোটের ফল দেখে চোখ কপালে উঠেছে তৃণমূল নেতৃত্বের। ব্লকের ১০টির মধ্যে ৪টি পঞ্চায়েতেই (খয়রাশোল, হজরতপুর, রূপসপুর ও লোকপুর) বিজেপি এগিয়ে গিয়েছে। বড়রা পঞ্চায়েতে সিপিএম। সামান্য ব্যবধানে পাঁচটি পঞ্চায়েতে (বাবুইজোড়, পারশুন্ডি, কেন্দ্রগড়িয়া, পাঁচড়া ও নাকড়াকোন্দা) এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল। আবার গোটা ব্লকে মোট প্রাপ্ত ভোটের হিসেবে তৃণমূল সিপিএমের থেকে এগিয়ে রয়েছে মাত্র ৪১০টি ভোটে। বিজেপির সঙ্গে শাসক দলের সেই ব্যবধান ১,৪৫১।
তৃণমূল সূত্রের খবর, খয়রাশোলে তৃণমূলের মূল গণ্ডগোল পঞ্চায়েতগুলি কোন গোষ্ঠীর হাতে থাকবে, তা নিয়েই। মাঝে খুন হয়ে যান এক গোষ্ঠীর মাথা অশোক ঘোষ। তার পর থেকেই এলাকা ছাড়া খুনে মূল অভিযুক্ত অনুব্রত-গোষ্ঠীর অশোক মুখোপাধ্যায় (যিনি খয়রাশোলে তৃণমূলের ব্লক সভাপতিও)। এত দিন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিহত অশোক ঘোষ অনুগামীদের হাতেই ছিল। এক স্থানীয় নেতার দাবি, “সম্প্রতি ঘোষ-গোষ্ঠীর সঙ্গে অনুব্রত বিশেষ ‘রফা’ করে দূরত্ব কমিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতাবান ঘোষ-গোষ্ঠীর, না খুনের মামলায় অভিযুক্ত মুখোপাধ্যায় গোষ্ঠীর খয়রাশোলে দলের সেনাপতি ঠিক কাদের কাছের লোক, তা নিয়ে দলেরই অন্দরে বিভ্রান্তি ছিল।” ক্রমাগত গোষ্ঠী কোন্দল এবং শেষমেশ তা মেটাতে উপযুক্ত নেতৃত্বহীনতার কারণেই খয়রাশোলের মানুষের একটা বড় অংশ তৃণমূূলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বলে দলের নিচুতলার কর্মীদেরই বিশ্লেষণ।
বিজেপির জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল কিন্তু মেনে নিচ্ছেন তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্ব, তাঁদের ফল ভাল হতে অনেকটাই সাহায্য করেছে। আবার তৃণমূলের এই খারাপ ফল নিয়ে সিপিএমের জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায়ের মত, “ওই দুই এলাকায় তৃণমূলের খারাপ ফলের পিছনে ওদের নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্ব একটা কারণ ঠিকই। তবে ঘটনা হল, যেখানেই সাধারণ মানুষ অবাধে ভোট দিতে পেরেছেন, সেখানেই ফল তৃণমূলের বিপক্ষে গিয়েছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy