Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

দানের জমিতে গড়ে ওঠা স্কুল দিশা দেখাচ্ছে শবরশিশুদের

শিক্ষা ও উন্নয়ন নিয়ে সরকারি স্তরে কিছু কাজ হলেও তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন ওঁরা। তাই শবর ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু করতে হবে এই ভাবনা থেকেই বছর তিনেক আগে পুরুলিয়ার পুঞ্চায় গড়ে ওঠে ‘পুঞ্চা নবদিশা মডেল স্কুল’। স্কুলটি মডেল কি না বলা যাবে না। স্কুলটি খোলার দায়িত্ব তাঁদের কেউ নেয়নি। স্বেচ্ছায় সেই দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন সুকুমার দাস, মমতা পরামানিক, পিউ পরামানিক ও শিবনাথ মাহাতোরা।

পুঞ্চা নবদিশা মডেল স্কুলে চলছে পড়াশোনা।  —নিজস্ব চিত্র

পুঞ্চা নবদিশা মডেল স্কুলে চলছে পড়াশোনা। —নিজস্ব চিত্র

সমীর দত্ত
পুঞ্চা শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

শিক্ষা ও উন্নয়ন নিয়ে সরকারি স্তরে কিছু কাজ হলেও তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন ওঁরা। তাই শবর ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু করতে হবে এই ভাবনা থেকেই বছর তিনেক আগে পুরুলিয়ার পুঞ্চায় গড়ে ওঠে ‘পুঞ্চা নবদিশা মডেল স্কুল’।

স্কুলটি মডেল কি না বলা যাবে না। স্কুলটি খোলার দায়িত্ব তাঁদের কেউ নেয়নি। স্বেচ্ছায় সেই দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন সুকুমার দাস, মমতা পরামানিক, পিউ পরামানিক ও শিবনাথ মাহাতোরা। প্রথম তিনজন পড়ান। শিবনাথবাবু একাধারে কেয়ারটেকার ও নৈশরক্ষী। তাঁদের সঙ্গ দিয়েছেন কলকাতা পুলিশের কনস্টেবল, পুঞ্চার বাসিন্দা অরূপ মুখোপাধ্যায়। এই কাজের জন্য তাঁরা কোনও পারিশ্রমিক না পেলেও স্কুলটা টিকিয়ে রাখতে আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রাক্তন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক সুকুমারবাবুর কথায়, “পুরুলিয়া জেলার মধ্যে পুঞ্চা থানা এলাকায় সব থেকে বেশি শবর পরিবার বাস করে। এরা এখনও সমাজের মূল স্রোতে মিশতে পারেনি। শিক্ষার হারও অনেক কম। সরকারি স্তরে এদের শিক্ষা ও উন্নয়ন নিয়ে কিছু কাজ হলেও আমাদের মনে হয়েছে এটা যথেষ্ট নয়। এর থেকেই স্কুল গড়ার ভাবনা। প্রথমে এগিয়ে আসেন পুঞ্চার পাড়ুই গ্রামের বাসিন্দা পেশায় পুলিশকর্মী অরূপবাবু।” তিনি জানান, অরূপবাবুর সঙ্গে ভাবনার মিল হলেও জায়গার অভাবে স্কুলটা গড়া যাচ্ছিল না। এই সময় পাশে দাঁড়ান পুঞ্চার বাসিন্দা ক্ষীরোদশশী মুখোপাধ্যায়। শবরশিশুদের জন্য স্কুল গড়তে তিনি ২২ ডেসিম্যাল জায়গা দান করেন। পাকা দেওয়াল। মাথায় অ্যাসবেসটসের ছাউনি দিয়ে চারটি ঘর নির্মাণ করা হয়। খরচ জুগিয়েছেন অরূপবাবুই। পুঞ্চা ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পিছনে রয়েছে স্কুলটি। বৃদ্ধ ক্ষীরোদশশীবাবু বললেন, “জায়গাটা তো পড়েই ছিল। ওঁরা যখন শবরশিশুদের জন্য স্কুল গড়ার জায়গা চাইলেন, তখন আর না করতে পারিনি। চাইলাম, জায়গাটা কোনও ভাল কাজে লাগুক।”

বর্তমানে ৩০ জন পড়ুয়া নিয়ে স্কুলটি চলে। আবাসিক স্কুলের খরচের সিংহভাগ বহন করেন ওই অরূপবাবু। তাঁর কথায়, “তিন শিক্ষক-শিক্ষিকা ও নৈশরক্ষীকে মাইনে দিতে পারি না। তবে রাঁধুনিকে মাসে ৭০০ টাকা দিতে হয়। পড়ুয়াদের খাবার ও পোশাকের জন্য আমার মাইনের অনেকটাই খরচ হয়ে যায়। তাই পরিচিত বন্ধুদের ধরে বইখাতা, পেনসিলের টাকা জোগাড় করি।” মানবাজারের বাসিন্দা, পেশায় বই ব্যবসায়ী মনোজ মুখোপাধ্যায় বলেন, “অরূপবাবু ওঁদের স্কুলের জন্য বই চেয়েছিলেন। আমি কিছু দিয়েছি। ওঁরা অনেক কষ্টে স্কুলটা চালাচ্ছেন।” পুঞ্চার দামোদরপুর গ্রামের বাসিন্দা হাসু শবর, তপন শবর, আকলু শবররা বলেন, “আমাদের ছেলেমেয়েরা ওই স্কুলে পড়ে। সেখানে থাকার সুবাদে আচার-ব্যবহার পাল্টেছে ছেলেমেয়েদের। পরিচ্ছন্নতা কী, তারা এক সময় জানত না। তেল সাবানের ব্যবহারও জানা ছিল না। শুধু তাই নয়, সপ্তাহে হয় তো এক দিন স্নান করত। এখন তারাই সাবান মেখে চুল আঁচড়ে স্কুলে যায়। দেখে আমাদের খুবই ভাল লাগে।”

নবদিশা স্কুলের পাশেই রয়েছে পুঞ্চা মাধ্যশিক্ষাকেন্দ্র। কেন্দ্রের প্রধান শিক্ষক শচীন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “নবদিশা থেকে কয়েকজন শবরপড়ুয়া আমার স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। কয়েকজনের ইংরেজি হাতের লেখা খুব সুন্দর। না বলে দিলে কেউ বুঝতে পারবে না এটা শবর পড়ুয়ার লেখা। লেখায় মার্জিন ব্যবহার করে ওরা।” সুকুমারবাবু বলেন, “প্রথম দিকে এদের শিক্ষা দিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। একবার বাড়ি গেলে আর আসতে চাইত না। এখন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বোঝে। নিয়ম করে নখ কাটে। আমরা লেখাপড়ার পাশাপাশি ব্যবহারিক আচরণও শেখাই।”

দুই শিক্ষিকা মমতা এবং পিউ পুঞ্চার লৌলাড়া কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। তাঁদের কথায়, “অরূপকাকু শবর ছেলেমেয়েদের পড়ানোর শিক্ষক খুঁজছিলেন। আমরা এক কথায় রাজি হয়ে যাই। এখন বুঝছি সেই সময় পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল করিনি।”

আর যাদের জন্য এত কিছু, সেই তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়া বাণী, দ্বিতীয় শ্রেণির প্রদীপ ও স্বপনের কথায়, “রোজ সকালে উঠে মুখ ধুয়ে দাঁত মাজতে হয় জানতাম না। এখানে এসে জানলাম। এখন স্কুলে যেতে বেশ ভাল লাগে।” পুঞ্চার বিডিও সুপ্রতীক সিংহ বলেন, “ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পিছনে শবর শিশুদের একটি বেসরকারি স্কুল ভাল কাজ করছে বলে জেনেছি। ওঁদের সাহায্য করার তেমন সুযোগ পেলে দেখব।”

অন্য বিষয়গুলি:

samir dutta puncha shabar child school
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE