এত দিন তিনিই ছিলেন সংগঠনের মূল অভিভাবক। সে পছন্দমতো জায়গায় ভোটের টিকিট পাওয়াই হোক বা দলীয় স্তরে পদোন্নতি, সব ক্ষেত্রে তাঁর দিকেই তাকিয়ে থাকতেন জেলার ছোট-বড়-মেজো নেতারা।
তিনি মুকুল রায়। পরিস্থিতির আমূল বদল হয়েছে গত ক’মাসে। দলে এখন তিনি সব পদ হারিয়ে কোণঠাসা। মাসখানেক আগেই শুশুনিয়ায় এসে আসন্ন পুরভোটের টিকিট বিলিতে বিধায়কদের ভূমিকাকে প্রাধান্য দিয়ে গিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই পরিস্থিতিতে পুরভোটের টিকিট পেতে কোন দরজায় কড়া নাড়তে হবে, তা বুঝে উঠতে পারছেন না জেলার অনেক নেতা।
এটা ঘটনা যে, বাঁকুড়া জেলায় শাসকদলের সংগঠনে মুকুল রায়ের প্রভাব খুব বেশি। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তিনটি স্তরেই মুকুল-ঘনিষ্ঠেরা টিকিট পেয়েছিলেন। জয়ের পরে কারা কোন পদ পাবেন, তা ঠিক করাতেও বড় ভূমিকা ছিল দলের এই সদ্য প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের। বাঁকুড়া পুরসভার ক্ষেত্রেও মুকুলবাবুর প্রভাব কম নয়। বাঁকুড়ার বর্তমান পুরপ্রধান শম্পা দরিপা দলীয় কাউন্সিলরদেরই আনা অনাস্থায় ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। আস্থা ভোটে হারার পরেও কিন্তু দলের নির্দেশে পুরপ্রধানের গদি বেঁচে গিয়েছিল শম্পাদেবীর। আর এর পিছনে মুকুলবাবুর অবদান কম ছিল না, আড়ালে এমনটাই জানাচ্ছেন জেলার একাধিক তৃণমূল নেতা।
সারদা-কাণ্ডকে ঘিরে দলনেত্রী মমতার সঙ্গে দূরত্ব বাড়ার আগে পর্যন্ত এই জেলার বহু তৃণমূল নেতা বা জনপ্রতিনিধিই নিজেকে ‘মুকুল-ঘনিষ্ঠ বলে জাহির করতেন। ছবিটা অবশ্য এখন পুরো উল্টো। সেই সব নেতাই এখন মুকুলবাবুর নাম প্রকাশ্যে মুখে আনতে চাইছেন না। জেলা তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা বলেন, “শুশুনিয়ায় এসে মুখ্যমন্ত্রী হাবেভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, মুকুল রায়ের লবির লোকেদের গুরুত্ব তিনি কমাচ্ছেন। আর সেই কারণেই পুরভোটের টিকিট বণ্টনের ক্ষেত্রে সাংগঠনিক পদে থাকা নেতাদের থেকেও বিধায়কদের বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন দলনেত্রী। দলের ভিতরের খবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা জানেন, আমাদের দলে ধীরে হলেও প্রাধান্য বেড়েছে শম্পা দরিপার বিরোধী হিসেবে পরিচিত নেত্রী অলকা সেন মজুমদার বা বাঁকুড়া শহরের বর্ষীয়ান তৃণমূল নেতা ও বাঁকুড়ার প্রাক্তন দুই পুরপ্রধান তারা কুণ্ডু, শান্তি সিংহের।”
দলীয় সূত্রে খবর, মমতা শুশুনিয়ায় এসে অলকাদেবী, তারাবাবু ও শান্তিবাবুদের পছন্দ মতো আসন দিতে বলে গিয়েছেন পুরভোটে। প্রার্থী নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে মতামত নিতে তপসিয়ায় তৃণমূল ভবনে ইতিমধ্যে ডাকও পড়ছে মুকুল-বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা হিসাবে পরিচিত অলকাদেবী, বাঁকুড়ার বিধায়ক মিনতি মিশ্র কিংবা ছাতনার বিধায়ক শুভাশিস বটব্যালদের। যদিও বিষয়টিকে এ ভাবে দেখতে নারাজ জেলা তৃণমূলের সভাপতি অরূপ খাঁ। তিনি বলেন, “শুধু বিধায়কেরাই প্রার্থী ঠিক করবেন, এ কথা ঠিক নয়। একটি কমিটি হয়েছে। সেই কমিটিতে বিধায়কদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুরসভার চেয়ারম্যান বা বিরোধী দলনেতারাও রয়েছেন। আমিও আছি। সবাই মিলেই প্রার্থী ঠিক করা হবে।”
যদিও ঘটনা হল, ‘পরিবর্তিত’ পরিস্থিতিতে মুকুল-শিবিরের নেতা-নেত্রীদের অনুগামীরা বেশ বিভ্রান্ত। ঠিক কার কার কাছে তদ্বির করলে টিকিট মিলবে, তা বুঝতে পারছেন না অনেকেই। তাই প্রার্থী হতে দলের একাধিক ছোট নেতা ভিড় জমাচ্ছেন মুকুল-বিরোধী গোষ্ঠীর নেতাদের বাড়িতে। বিভ্রান্তি শুধু যে নিচুতলাতেই সীমিত, এমন নয়। প্রকাশ্যে এ নিয়ে কিছু না বললেও, কোন পথে হেঁটে নিজের অনুগামীদের হাতে টিকিট এনে দেওয়া যায়, তা খুঁজতে ব্যস্ত জেলার বড় তৃণমূল নেতারাও।
বাঁকুড়া পুরসভায় গত অনাস্থার সময়ে শম্পাদেবীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাম সমর্থিত নির্দল কাউন্সিলর বিশ্বজিত্ কুণ্ডু। গত লোকসভা ভোটের ঠিক আগে শম্পাদেবীর হাত ধরে মুকুল রায়ের আশীর্বাদ নিয়ে তিনি তৃণমূলে যোগও দেন। জেলা তৃণমূল সূত্রের খবর, আসন্ন পুরভোটে ৩ নম্বর ওয়ার্ডেই যাতে বিশ্বজিত্বাবু তৃণমূলের টিকিট পান, তার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন শম্পাদেবী। কিন্তু দলেরই আর একটি গোষ্ঠী ওই ওয়ার্ডে চাইছেন তৃণমূল নেতা দিলীপ অগ্রবালকে। শম্পাদেবীর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর লোক হিসেবে পরিচিত দিলীপবাবু বর্তমানে বাঁকুড়া পুরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। ওই ওয়ার্ডটি এ বার সংরক্ষিত। তাই বিশ্বজিত্বাবুর বদলে ৩ নম্বর ওয়ার্ডে দিলীপবাবুকে প্রার্থী করার দাবি তুলেছে দলের অন্য গোষ্ঠী। এ প্রসঙ্গে শম্পাদেবীর বক্তব্য, “বর্তমান কাউন্সিলরদের টিকিট দেওয়ার ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বজিত্বাবুও বর্তমান কাউন্সিলর হিসাবে টিকিটের দাবিদার হতে পারেন। এর মধ্যে অন্যায় কিছু নেই।”
বাঁকুড়া পুরসভারই ২০ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর দেবদাস দাসকে নিয়েও অস্বস্তি শুরু হয়েছে দলের অন্দরে। দেবদাসবাবুর নিজের ওয়ার্ডটি সংরক্ষণের আওতায় পড়ছে না। কিন্তু, তিনি নিজে এ বার তফসিলি জাতি-উপজাতির জন্য সংরক্ষিত ওয়ার্ড ৭ নম্বরে দাঁড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন দলের কাছে। অন্য দিকে, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর শান্তি সিংহ ওই ওয়ার্ডের প্রার্থী হিসেবে অন্য এক জনকে টিকিট দেওয়ার জন্য দলের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। ফলে সমস্যা দানা বেঁধেছে। একই ভাবে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী হওয়া নিয়ে চাপা দ্বন্দ্ব শান্তিবাবু এবং এই ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলর রেখা দাস রজকের মধ্যে। শাসক দলের প্রার্থী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একই ভাবে তেতে উঠেছে শহরের ৫,৯,১৬,১৮ এবং নতুন ওয়ার্ড হিসেবে উঠে আসা ২৪ নম্বর।
দলের ভিতরের এই দ্বন্দ্বকে অবশ্য গুরুত্ব দিতে নারাজ জেলা তৃণমূল সভাপতি। তাঁর কথায়, “সবাই দলের কর্মী। প্রার্থী হতে চাইতেই পারেন। এঁদের মধ্যে থেকেই যোগ্য লোক বাছাই হবে।” রবিবার প্রার্থী তালিকা সংক্রান্ত একটি বৈঠক করতে বাঁকুড়ায় আসার কথা দলের বাঁকুড়া জেলা পর্যবেক্ষক শুভেন্দু অধিকারীর। এই বৈঠককে কেন্দ্র করে হোমওয়ার্ক শুরু করে দিয়েছেন জেলা তৃণমূলের নেতানেত্রীরাও। কার কার কপালে শেষ অবধি শিকে ছেঁড়ে, তা অবশ্য সময়ই বলবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy